ডাকাতিয়ায় ড্রেজিংয়ের নামে বালি বাণিজ্য

বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর : চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার ডাকাতিয়া নদী খনন প্রকল্পের নাম ভাঙিয়ে নদী থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ বালিদস্যু চক্র। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে বালি দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার পুকুর ডোবা ফসলি জমি ভরাট করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন এ চক্রটি। ফলে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ফসলি জমিসহ নদীর ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে প্রকল্পের  লক্ষ্য উদ্দেশ্য যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হয়ে স্থানীয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় প্রাণ-প্রকৃতি প্রান্তিক কৃষক ও ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

সূত্রমতে, অভ্যন্তরীণ নৌ-পথে সারা বছর পণ্য ও যাত্রীবাহী নৌ-যানগুলোর নির্বিঘœ ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) উদ্যোগে ৫৩টি নৌ-পথের ক্যাপিটাল ড্রেজিং শীর্ষক প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। তার ধারাবাহিকতায় বিআইডব্লিউটিএ’র মাস্টার প্ল্যানে চতুর্থ শ্রেণি জলপথের আওতায় চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীর একটি অংশ খননের প্রস্তাব করা হয় প্রকল্পে। প্রকল্পের সমীক্ষায় বলা হয়, চলাচল এবং সেচ জল সরবরাহের জন্য ডাকাতিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। ডাকাতিয়া নদী চাঁদপুর থেকে শাহরাস্তি থানার চিতোষী পর্যন্ত নাব্য সংকটে রয়েছে। বাণিজ্যিক কারণে এ নৌ-পথের নাব্য উন্নয়ন প্রয়োজন। পরে প্রকল্পে চাঁদপুর-ইচুলি-হাজীগঞ্জ নৌ-পথের খননকাজ লট ১ ও লট ২ প্যাকেজের মাধ্যমে শুরু করা হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে। প্যাকেজ চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সালে খনন কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অদ্যাবধি চলমান রয়েছে ডাকাতিয়ায় ড্রেজিং কাজ।

এদিকে প্রকল্পের বাস্তবায়নাধীন কাজ রুট ওয়াইজ অগ্রগতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রকল্পের আওতায় চাঁদপুর-ইচুলী-হাজীগঞ্জ নৌ-রুটে ডাকাতিয়া নদীতে ৭১ কিলোমিটার এলাকায় চুক্তি অনুযায়ী (লট-১) খননের পরিমাণ ছিল দশ দশমিক পাঁচ লাখ ঘনমিটার। লট-২ অনুযায়ী আঠারো লাখ ঘনমিটার বালি। ২৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা চুক্তিমূল্যের এ কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনও চলমান রয়েছে ড্রেজি কার্যক্রম। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বছরের পর বছর একটার পর একটা প্রকল্প চলমান থাকার পরও ডাকাতিয়া নৌপথ এখন পর্যন্ত নৌ-যান চলাচলের সম্পূর্ণ উপযোগী করা যায়নি বলে জানা গেছে। 

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ৬০ মিটার প্রস্থ ও তিন দশমিক সাত মিটার গভীরতা পর্যন্ত নাব্য উন্নয়নের জন্য উদ্যোগ নিলেও নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলন করে বিভিন্ন পুকুর ডোবা গর্ত জলাশয়সহ ফসলি জমি ভরাট করার অভিযোগ ওঠে। অপরিকল্পিত বালি উত্তোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতাকর্মীরা। ফলে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অপরিকল্পিতভাবে ডাকাতিয়া থেকে বালি উত্তোলন করে পুকুর ডোবা জলাশয় ভরাট করার কারণে ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্তসহ মাছ ও জলজ প্রাণীর বিচরণক্ষেত্র বিনষ্ট হচ্ছে।

এদিকে ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতাকর্মীর বালি উত্তোলন বাণিজ্য ও নদীর পাড় ক্ষতিগ্রস্ত দেখিয়ে মেরামতের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পের একশ মিটার এলাকা থেকে বালি উত্তোলনের নিয়ম না থাকলেও শাহরাস্তি ওয়াকওয়ে প্রকল্প এলাকার ডাকাতিয়া নদী থেকেও বালি উত্তোলন করতে দেখা গেছে প্রভাবশালী ওই চক্রটিকে। এতে ওয়াকওয়ে প্রকল্পটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

অপরদিকে উপজেলা প্রশাসনের নাকের ডগায় বালি ফেলে পানি নিষ্কাশনের খাল ভরাট করার পরও স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা রয়েছেন নীরব। নদীর পাশে ফসলি জমি বিনষ্ট করে বালির স্তূপ দেয়া হলেও নেয়া হচ্ছে না আইনি পদক্ষেপ। এছাড়া বালি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুসরণ না করে সরকারি কোষাগারে নামমাত্র অর্থ দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার বালি উত্তোলন করে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ ওঠে ডাকাতিয়ার খনন কাজে। অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলনের ফলে প্রকল্প এলাকার কিছু জনগণ উপকৃত হলেও বিভিন্ন এলাকার নদীপাড়ের কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এখন কোনো প্রকল্পের আওতায় ডাকাতিয়া খনন করা হচ্ছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন রশিদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আসলে কোনো প্রকল্পের আওতায় খনন করা হচ্ছে তা আমার জানা নেই। আমরা চিঠি পেয়েছি। চিঠি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমজাদ সাহেবের কাছে আছে। কথা বলে জানাব।’ এরপর তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেও আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যে বদলি হয়েছেন সহকারী কমিশনার আমজাদ হোসেন।

প্রকল্পে লট-১ খনন কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম এস বঙ ড্রেজার্স লিমিটেড ও লট-২ কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেডের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। ডাকাতিয়ায় নতুন একটি প্রকল্পের আওতায় ড্রেজিং করা হচ্ছে বলে ড্রেজিং কাজের দায়িত্বে থাকা কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন প্রভাবশালী নেতা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০