Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 2:25 pm

ডাচ্-বাংলার এজেন্টের ‘চেকের ফাঁদে’ সর্বস্বান্ত গ্রাহক

জুনায়েদ আহম্মেদ, লক্ষ্মীপুর: ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে কত টাকা আছে, সেটা যাচাই করতেন এজেন্ট ব্যাংক ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন মাহমুদ। টাকা বেশি থাকলেই সেই গ্রাহককে উচ্চ মুনাফার লোভ দেখানো হতো। সেই টাকা এফডিআর না করে তার কাছে রাখতে বলা হতো। গ্রাহকের টাকা নিয়ে দেয়া হতো ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্ল্যাঙ্ক বা খালি চেক। কয়েক মাস মুনাফাও দেয়া হতো। এভাবে মুনাফার লোভ আর চেকের ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা। অবশেষে সেই টাকা নিয়ে লাপাত্তা লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং শাখার ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন মাহমুদ। ১২ দিনেও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। গ্রাহক টানতে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের খালি চেকের ফাঁদ পাতা হলেও ব্যাংক বলছে, চেক দিয়ে ব্যক্তিগত লেনদেনের দায় ব্যাংক নেবে না।

সূত্রমতে, ১২ দিন পার হলেও লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট শাখার ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন মাহমুদের (৪০) খোঁজ এখনও মেলেনি। এজেন্ট ব্যাংকের আড়ালে মোটা মুনাফার লোভে সর্বস্বান্ত মানুষ দিশাহারা। এ ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ মহিউদ্দিন মাহমুদের পরিবারের সদস্যরাও আত্মগোপনে রয়েছেন।

অন্যদিকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, গ্রাহকদের কোনো টাকা আত্মসাৎ হয়নি, তবে চেক দিয়ে ব্যক্তিগত লেনদেনের দায় ব্যাংক নেবে না। এ ঘটনায় এজেন্ট আউটলেট দুটির সাময়িক ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধের নোটিশ টানিয়ে দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এর আগে ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুর থেকে নিখোঁজ হন মহিউদ্দিন। গতকাল শনিবার দুপুর পর্যন্ত এ নিয়ে থানায় কোনো অভিযোগ কেউই দাখিল করেনি বলে জানান কমলনগর থানার ওসি মোহাম্মদ সোলায়মান।

নিখোঁজ মহিউদ্দিন উপজেলার চর লরেঞ্চ বাজারে লাবিব এন্টারপ্রাইজ এবং করইতলা বাজারে তাজ এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অধীন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের দুটি এজেন্ট আউটলেটের ব্যবস্থাপক ছিলেন ও হাজিরহাট ইউনিয়নের চরজাঙ্গালিয়া গ্রামের হাবিব উল্লাহর ছেলে। তিনি এলাকায় কুতুব উল্লাহ নামে পরিচিত ছিলেন।

চর লরেঞ্চ বাজারের স্থানীয় কয়েকজন ভুক্তভোগী ও ব্যবসায়ী জানান, ব্যাংকের গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে, এটা যাচাই করে ওই গ্রাহককে উচ্চ মুনাফার ফাঁদে ফেলতেন মহিউদ্দিন মাহমুদ। তারপর এফডিআর ব্যাংকে না করে ব্ল্যাংক চেক দিয়ে উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। কয়েক মাস মুনাফাও দিয়ে অন্য গ্রাহকদের বিশ্বাস লাগিয়ে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা এই এজেন্ট ব্যাংকার।

জুয়েল নামের একজন গ্রাহক জানান, এজেন্ট শাখাটিতে তার অ্যাকাউন্টে সরাসরি গচ্ছিত টাকা ঠিক আছে। তবে এজেন্ট মহিউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে যারা ব্যক্তিগতভাবে ব্ল্যাঙ্ক চেকের গ্যারান্টি ও স্ট্যাম্প গ্যারান্টিতে মাসিক উচ্চ লাভের আশায় টাকা জমা রেখেছিলেন, মাহমুদ না ফিরলে তারা সর্বস্বান্ত হবেন। মূলত ব্যাংকিংয়ের আড়ালে সুদের ব্যবসা পরিচালনা করতেন মাহমুদ, এমনও জানালেন জুয়েলসহ কয়েকজন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী নুরুল ইসলাম জানান, অনেকে ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে এজেন্ট মহিউদ্দিন মাহমুদের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা রেখে মাসিক লাভ নিচ্ছিলেন। এখন এজেন্ট উধাও হওয়ার খবরে নিজেদের গচ্ছিত টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। তবে এরকম কতজন ব্যক্তি রয়েছেন, তার কোনো সঠিক তথ্য জানাতে পারেননি কেউ। স্থানীয়ভাবে বিভিন্নজন এ প্রতিবেদকের কাছে সাত কোটি ৪০ লাখ টাকার একটি হিসাব দেন। তবে এর পরিমাণ আরও বাড়বে বলে মনে করেন এই  বীর মুক্তিযোদ্ধা।

অন্যদিকে প্রতারণায় পড়ে নিজেদের ক্ষতির আশঙ্কা করে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নিজেদের অর্থের পরিমাণ এবং গ্যারান্টি হিসেবে ব্যাংক চেক ও স্ট্যাম্পের কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছেন বহু ব্যক্তি। এর মধ্যে চর লরেঞ্চ বাজারের একটি কম্পিউটার দোকানে এ রকম ৭২টি চিঠি প্রিন্ট হয়েছে। ওই ৭২টি চিঠির মধ্যে সর্বনি¤œ ১০ হাজার থেকে ৮১ লাখ টাকার মালিকও রয়েছে।

চর লরেঞ্চ গ্রামের চুঙ্গার গোড়া এলাকার বাসিন্দা মোসলেহ উদ্দিন শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন থেকে সুনামের সঙ্গে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল এজেন্ট শাখাটি। ভালো আচরণের মাধ্যমে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেন এজেন্ট মহিউদ্দিন। প্রবাস থেকে দেশে আসার পর ছয় লাখ টাকার একটি ডিপিএস করেন ওই শাখায়। একপর্যায়ে মহিউদ্দিন মাহমুদ তার ডিপিএসে জমানো অর্থগুলো উত্তোলন করে তার কাছে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন। এতে তিনি প্রতি মাসে লাখে এক হাজার ২০০ টাকা করে মুনাফা দেয়ার কথা জানান। পরে তিনি গ্যারান্টি হিসেবে একটি চেক ও স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে দেন। কয়েক মাস নিয়মিত লাভও দিয়েছেন। শুক্রবার বিকালে তিনি জানতে পারেন ১০-১২ দিন ধরে উধাও মহিউদ্দিন।

চর লরেঞ্চ গ্রামের ইউছুফ অন্য একটি ব্যাংকের ঋণ নিয়ে সাত লাখ এবং অন্য আত্মীয়স্বজনের ২৩ লাখসহ মোট ৩০ লাখ মহিউদ্দিন মাহমুদের কাছে মাসিক লাখে এক হাজার ২০০ টাকা মুনাফা দেয়ার শর্তে জমা রেখেছিলেন। গত কয়েক মাস লাভও পেয়েছেন। চর জাঙ্গালিয়ার হারুনের পাঁচ লাখ, জুয়েলের ১৭ লাখ, চর জগবন্ধুর তানিয়া আক্তারের চার লাখসহ অসংখ্য স্থানীয় এলাকাবাসীর লাখ লাখ টাকা মহিউদ্দিন মাহমুদের কাছে মাসিক লাভে জমা রাখার খবর জানা গেছে। মহিউদ্দিন মাহমুদের উধাও হওয়ার খবরে তারা সবাই ভেঙে পড়েছেন।

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেটের কর্মী জান্নাতুল ফেরদৌসী অভি জানান, ঘটনার দিন বেলা ১টায় মহিউদ্দিন বাইরে থেকে এসে তার ব্যবহƒত দুটি মোবাইল ফোন ও ব্যাংক কার্ড রেখে বলেছিলেন, তাকে কেউ একজন বাইরে ডাকছে। আমি ফোন ও কার্ড রেখে গেলাম। এর প্রায় ৪০ মিনিট পর তিনি আরেক নম্বর থেকে তার একটি ফোনে কল দেন। ফোনটি আমি রিসিভ করি। তখন তিনি আমাকে জানান, অভি দুজন লোক আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে, তারা আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করছে। তুমি এ বিষয়টি আমার ভাইকে জানাও। এ কথা শুনেই আমি সঙ্গে সঙ্গে তার ভাই হারুন অর রশিদকে ঘটনাটি জানাই।

এদিকে মহিউদ্দিন মাহমুদের ভাই হারুন অর রশিদ জানান, অভির কল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ৯৯৯-এ কল দিয়ে পুলিশের সহযোগিতা চাই। পরে করইতলা থেকে চর লরেঞ্চ চলে যাই। ততক্ষণে থানা থেকে পুলিশ আসে। এর পর থেকে আজ পর্যন্ত আমার ভাইয়ের আর কোনো খোঁজ নেই।

মহিউদ্দিন মাহমুদ পরিবার নিয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা শহরে বসবাস করতেন। তার দুই মেয়ে রয়েছে। স্ত্রী শিল্পী আক্তারের নম্বরে কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

ডাচ্-বাংলা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কম্পলায়েন্স ম্যানেজার মাইন উদ্দিন মিয়া জানান, এ ঘটনার পর থেকে এজেন্ট আউটলেট দুটি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে গ্রাহকরা যে কোনো শাখা থেকে লেনদেন করতে পারবেন। আমাদের কাছে ৬০-৭০ জন গ্রাহক অভিযোগ করেছেন। তাদের মধ্যে কেউই আমাদের ব্যাংকে টাকা রাখার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।

কমলনগর থানার ওসি মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, ঘটনার দিন ৯৯৯-এর কল পেয়ে আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। তবে এখন পর্যন্ত থানায় কোনো জিডি কিংবা কোনো অভিযোগ কেউ করেনি।