ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে হিসাব খোলায় জালিয়াতি

রোহান রাজিব: ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ময়মনসিংহের ভালুকা শাখায় বগুড়ার এক মসজিদের ইমামের অনুপস্থিতি ও স্বাক্ষর ছাড়াই জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক হিসাব খোলার অভিযোগ উঠেছে। বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার শালিখা গ্রামের একটি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম তোফায়েল আহমেদ এ অভিযোগ তুলে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছেন। একই সঙ্গে জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তিনি।

জানা যায়, তোফায়েল আহমেদকে ভালো বেতনের চাকরি পাইয়ে দেয়ার কথা বলে প্রতিবেশী আনারুল ইসলাম তার কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রসহ কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করেন। সেই কাগজপত্র দিয়ে গ্রাহকের উপস্থিতি ছাড়াই জালিয়াতি করে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ভালুকার সিডস্টোর শাখায় খোলা হয় ব্যাংক হিসাব। এ কাজে সহায়তা করেন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ওই ব্যাংক হিসাবের বিপরীতে ইস্যু করা চেক বইয়ের পাতা দেয়া হয় এক পাওনাদারকে। সেই পাওনাদার আবার ডাচ্বাংলা ব্যাংকের একটি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটের স্বত্বাধিকারী, তার নাম মফিজুল ইসলাম।

চেক দেয়া হলেও ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা না থাকায় সেটি ডিজঅনার হয়। এমন পরিস্থিতিতে পাওনাদার চেক ডিজঅনারের মামলা করেন। অথচ এত ঘটনার বিষয়ে কিছু জানতেনই না ভুক্তভোগী তোফায়েল আহমেদ। সরল বিশ্বাসে প্রতিবেশীর কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে তিনি ভয়ংকর প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এমন পরিস্থতিতে মামলা থেকে নিষ্কৃতি পেতে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শরণাপন্ন হয়েছেন। একই সঙ্গে প্রতিকার চেয়ে তিনি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত প্রতিবেশী আনারুল ইসলাম ও এজেন্ট ব্যাংকিং আইটলেটের স্বত্বাধিকারী মফিজুল ইসলামের বিরুদ্ধে পালটা মামলা করেছেন। আর মামলা থেকে রেহাই দিতে তোফায়েল আহমেদের কাছে আট লাখ টাকা দাবি করছেন মফিজুল ইসলাম। একদিকে মামলার খরচ চালানো, অন্যদিকে প্রতারক চক্রের হয়রানির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন তোফায়েল আহমেদ।

শেয়ার বিজের হাতে আসা মামলার নথিপত্র ও বাংলাদেশ ব্যাংকে দেয়া অভিযোগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার গুজিয়াম গ্রামের বাসিন্দা মফিজুল ইসলামের নামে ইস্যুকৃত ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের দুটি চেক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। মফিজুল ব্যাংকটির একটি এজেন্ট আউটলেটের স্বত্বাধিকারী। টাকার পরিমাণ ১৭ লাখ ৪৬ হাজার। ২৮১১৫২০০০১৯৯২ নং হিসাবের যথাক্রমে চেক নং ৬৭৮৯১৬২-এ আট লাখ ও ৬৭৮৯১৬৪ নং চেকে ৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকা উল্লেখ করে তাকে পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। মফিজুলের দাবি, তোফায়েল এ চেক দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এটি দিয়েছেন আনারুল ইসলাম। কিন্তু তিনি মফিজুলের কাছে নিজের নাম ঠিকানা গোপন করে নিজেকে তোফায়েল হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। পুরো বিষয়টিই এই চক্রান্ত বলে ধারণা করছেন ভুক্তভোগী তোফায়েল আহমেদন। যে চক্রান্তের সঙ্গে ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তোফায়েল আহমেদ বগুড়ার সোনাতলা এলাকার বাসিন্দা। তার বিরুদ্ধে চেক প্রত্যাখ্যানের অভিযোগ এনে ময়মনসিংহের ৮নং আমলী আদালতে ন্যাগশিয়েবল ইনস্ট্র–মেন্ট আইনের ১৩৮ ধারা অনুযায়ী একটি মামলা করেন মফিজুল ইসলাম। মামলার নম্বর ৯/২৩। আদালতের পরোয়ানা পেয়ে তোফায়েল আহমেদ আদালতে হাজিরা দিয়ে এ মামলায় জামিন নেন। এরপর ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা ব্যবস্থাপককে একটি আইনি নোটিশ পাঠান।

এ বিষয়ে অভিযোগকারী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, তার অগোচরে প্রতারণার উদ্দেশ্যে ডাচ বাংলা ব্যাংকের ভালুকা সিডস্টোর শাখায় হিসাবটি খোলা হয়েছে। তিনি কখনোই ময়মনসিংহে যাননি। তার বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী মফিজুল ইসলামের সঙ্গে কখনোই কোনো মাধ্যমে যোগাযোগ হয়নি।

শেয়ার বিজের কাছে ভুক্তভোগী দাবি করেন, নিজস্ব সোর্স ব্যবহার করে তিনি হিসাবের নথিপত্র ব্যাংকের সার্ভার থেকে দেখেছেন। তাতে এনআইডির সঙ্গে ব্যাংক হিসাবের স্বাক্ষরে গরমিল রয়েছে। ব্যাংক হিসাবে ব্যবহƒত মোবাইল নম্বরটিও তার নয়। ব্যাংক হিসাবে যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে তাও তোফায়েলের নয়। শুধু নাম ঠিকানা তার। এতে  তোফায়েল নিশ্চিত হয়েছেন, প্রতিবেশী আনারুল ইমামতির চাকরির কথা বলে তার কাছ থেকে নেয়া এনআইডি ব্যবহার করে ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে হিসাবটি খুলেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি মফিজুল ও

প্রতিবেশী আনারুলের বিরুদ্ধে মনসিংহের ৮নং আমলি আদালতে একটি পাল্টা মামলা দায়ের করেন। যে মামলার নম্বর ৫২৭/২০২৩।

তোফায়েলের প্রতিবেশী অভিয–ক্ত আনারুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেন তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘তোফায়েল আহমেদ আমার প্রতিবেশী। মামলা করেছে শুনেছি।’ কর্মকর্তার যোগসাজশে তোফায়েলের এনআইডি দিয়ে ব্যাংক হিসাব খুলেছেন কি না এমন প্রশ্ন করা হলে আনারুল ইসলাম ফোন কেটে দেন। 

ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ও তোফায়েলের বিরুদ্ধে করা চেক ডিজওনারের মামলার বাদী মফিজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অ্যাকাউন্টের তথ্য ব্যবহার করে আমি মামলা করেছি। তোফায়েল নামের ব্যক্তির সঙ্গেই আমি নিয়মিত লেনদেন করতাম। তিনিই আনারুল কি-না তা আমি জানি না। স্থানীয় সব মানুষ তাকে তোফায়েল নামেই চিনত। আমার কাছ থেকে টাকা নেয়ার পর হঠাৎ সে গা ঢাকা দেয়। তাই আমি মামলা করেছি।’

অভিযোগকারীর অনুপস্থিতিতে ছবি ও স্বাক্ষর ছাড়াই কীভাবে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে জানতে চাইলে ডাচ বাংলা ব্যাংকের ভালুকা সিডস্টোর বাজার শাখা ব্যবস্থাপক কামরুজ্জামান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করা হয়েছে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সব ডকুমেন্ট পাঠিয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি তদন্ত করছে। তাই বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।’ এনআইডি ছাড়া হিসাব খোলা হয়েছে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা কোনোভাবে সম্ভব নয়। বিষয়টি প্রধান কার্যালয়ের তদন্তের অধীন রয়েছে, সেখানে যোগাযোগ করুন।

পরে এ বিষয়ে জানতে প্রধান ডাচ বাংলা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গেলে ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা বলেন, লিগ্যাল নোটিশ পাওয়ার পর নোটিশ দাতার নিকট শাখা থেকে কিছু কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। এখনও কাগজপত্র দেয়নি। তবে অভিযোগকারী তোফায়েল শেয়ার বিজের কাছে দাবি করেন তার কাছে কোনো কাগজপত্র চাওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিযোগ পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে এ বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা চায়। কিন্তু ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো উত্তর পাঠানো হয়নি বলে জানা গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে গ্রাহকের এনআইডি, ছবি ও স্বাক্ষর ছাড়া হিসাব খোলা খুবই কঠিন। একজনের তথ্য দিয়ে অন্য কেউ হিসাব খোলা প্রায় অসম্ভব। সাধারণভাবে বুঝা যাচ্ছে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার যোগসাজশেই এমন ঘটনা ঘটেছে। তদন্তে বিষয়টি বেরিয়ে আসবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় অন্য কারও তথ্য ব্যবহার করে হিসাব খোলা হয়েছে, তাহলে ব্যাংককে এর দায় নিতে হবে। তখন জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যাংককে নির্দেশনা দেয়া হবে। ব্যাংকই তখন ব্যবস্থা নেবে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০