প্রতিনিধি, পঞ্চগড়: বিধিনিষেধ অমান্য করেই নির্বিচারে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ডাহুক নদীতে চলছে পাথর উত্তোলন। এতে করে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এ নদীটি। গতিপথ হারিয়ে ক্রমাগতভাবে হারাচ্ছে চিরচেনা রূপ। একসময় অত্যাধুনিক ড্রেজার মেশিনের সাহায্যে পাথর তোলার কারণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে নদীটি। ড্রেজারের পর এখন অভিনব পদ্ধতিতে ট্রাক্টর দিয়ে তোলা হচ্ছে নদীর বুক চিরে পাথর। পাথরখেকোদের অত্যাচারে হারিয়ে যেতে বসেছে ডাহুক নদী।
জানা যায়, ভারত থেকে উৎপত্তি হয়ে ১৪ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে ফের ভারতে ঢুকে গেছে ডাহুক। এর পশ্চিমে শালবাহান ইউনিয়ন ও পূর্বে রয়েছে বুড়াবুড়ি ইউনিয়ন। দুটি ইউনিয়নের নদী ও নদীর ধারে কাছে রয়েছে হাজার হাজার একর কৃষিজমি। চা বাগান থেকে শুরু করে আমসহ নানা ফল ও ফসলের বাগান।
গত রোববার দুপুরে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, লোহাকাচি-বালাবাড়ী ডাহুকের বুক চিরে ট্রাক্টর দিয়ে পাথর উত্তোলন করছেন শ্রমিকরা। একটি ট্রাক্টর দিয়ে পাথর তুলতে ৮-১০ শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়। এভাবেই ডাহুক নদীর শালবাহান মাঝিপাড়া, কালিতলা, লোহাকাচী, বালাবাড়ী, বুড়াবুড়ির কাটাপাড়া, সরকারপাড়া ও হারাদিঘি এলাকায় নদীতে পাওয়ার ট্রাক্টর দিয়ে পাথর তোলার খবর পাওয়া যায়।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডাহুক নদীতে প্রতিদিন নির্বিচারে তোলা হচ্ছে পাথর। ড্রেজার মেশিনের সময় থেকেই নদীটি ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। এখন ড্রেজার মেশিনের পর অভিনব পদ্ধতি হিসেবে ট্রাক্টরের ইঞ্জিনের সাহায্যে নদীর গভীর থেকে তোলা হচ্ছে হাজার হাজার সিএফটি পাথর। নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাক্টর দিয়ে তোলা হচ্ছে পাথর। রয়েছে ৮০ থেকে ১০০টি সাইট। এসব সাইট নিয়ন্ত্রণ করে পাথর তুলছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। জড়িত রয়েছেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিও।
তারা আরও জানান, ডাহুক নদীতে চাষাবাদে রয়েছে ব্যাপক অবদান। বর্ষাকালে পলিমিশ্রিত পানি ছড়িয়ে দেয় এই নদী। শুষ্ক মৌসুমে ডাহুকের প্রবাহিত পানি চাষাবাদের জমিকে উর্বর করে। ডাহুকে রয়েছে নানা প্রজাতির মাছ। সারাবছর এ নদী থেকে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ টন মাছ আহরণ করেন দুই ইউনিয়নের শতাধিক জেলে। এলাকার হাজার হাজার মানুষের আমিষের চাহিদা মেটায় এই মাছ। ক্রমাগতভাবে পাথর উত্তোলনের কারণে নদী হারাচ্ছে গতিপথ, হারাচ্ছে নিজের চিরচেনা রূপ। চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এই ডাহুক।
কারা কারা এসব সাইট চালাচ্ছেনÑএমন প্রশ্ন করলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু শ্রমিক জানান, আমরা শুধু পাথর তোলার কাজ করি। এসব সাইট চালানোর মহাজন রয়েছে।
আব্দুল জলিল নামের একজন প্রশাসনকে ম্যানেজ করার নামে প্রত্যেক পাথর সাইট থেকে হাজার হাজার টাকা নিচ্ছেন বলে জানা যায়। সে টাকা সিন্ডিকেটের বিভিন্ন সদস্যের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। কয়েক দিন আগে তেঁতুলিয়া চৌরাস্তা বাজারে একটি বিকাশের দোকান থেকে ম্যানেজ করার নামে টাকা পাঠাতে দেখা যায় আব্দুল জলিলকে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আব্দুল জলিল জানান, আমি কোনো চাঁদা নিই না। মালিকানা জমিতে পাথর উত্তোলন করছি।
পাথর শ্রমিকরা বলছেন, ডাহুকে হাজার হাজার শ্রমিক পাথর উত্তোলন করে নিজেদের সংসার চালাচ্ছেন। অন্যদিকে দেশের রাস্তাঘাট ও ভবন নির্মাণে কাজে লাগছে এই পাথর। তবে তারা স্বীকার করছেন, অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে ডাহুকের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পাথর শ্রমিকরা জানান, সাইট মালিকরা যেভাবে আমাদের পাথর তুলতে বলেন আমরা সেভাবেই তুলি।
পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখা থেকে জানা যায়, গত ২০১৩ সালের মার্চ মাসের ১৪ তারিখের গেজেট প্রকাশের পর বাংলা ১৪২৬ সন থেকে সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডাহুক নদীর পাথর মহাল ইজারা বন্ধ করা হয়েছে। অথচ সরকারি সিদ্ধান্তকে তোয়াক্কা না করে অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে শ্রমিক নামিয়ে পাথর উত্তোলন করেই চলছে। এতে করে সরকার যেমন হারাচ্ছে রাজস্ব, তেমনি অপরিকল্পিতভাবে নির্বিচারে পাথর উত্তোলনের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে এ নদী।
শালবাহান ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমার কিছু ট্রাক্টর আছে। তা দিয়ে পাথর লোড-আনলোড হয় সত্য, তবে এ অঞ্চলের শত শত শ্রমিক সাধারণভাবে পাথর তুলে জীবিকা নির্বাহ করছে। এ পাথরের ওপরেই তাদের জীবনজীবিকা।
তেঁতুলিয়া মডেল থানা পুলিশের ওসি সুজয় কুমার রায় জানান, আমি এ থানায় কিছুদিন হলো যোগদান করেছি। কোথায় পাথর উত্তোলন হচ্ছে, তা নিয়ে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। তবে ট্রাক্টর দিয়ে পাথর উত্তোলনকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফজলে রাব্বি বলেন, বিষয়টি নিয়ে প্রশাসন তৎপর রয়েছে, যাতে কোনোভাবেই ডাহুক নদীতে এ ধরনের ট্রাক্টর দিয়ে কেউ পাথর তুলতে না পারে। এর আগেও ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এবং তা চলমান থাকবে।