বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১৯৮০ সালে ১০৮ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ২০১৪ সালে ৪২২ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। এর প্রাদুর্ভাব উন্নত বিশ্বের গণ্ডি পেরিয়ে মধ্য ও নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলোয় বিপজ্জনক হারে বেড়ে চলেছে। সচেতনতাই পারে এর ভয়াবহতা থেকে রোগীকে মুক্ত করতে। এ উদ্দেশ্যে খুব অল্প কথায়, সহজ করে আজকের এ লেখা।
আমরা জানি, দেহ গ্রহণকৃত খাবার হজম ও শোষণপূর্বক শরীরের সব কোষের প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দেয়। আজকে আলোচনা করব যে, এ সিস্টেমটি ঠিকমত কাজ করতে না পারার ওপর কীভাবে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়া নির্ভর করে।
যখন আমরা কোনো খাবার খাই, তখন খাবারের মধ্যে বিদ্যমান কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা পাকস্থলীতে পৌঁছে ডাইজেস্টিভ সিস্টেম দ্বারা ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হয়। আমাদের শরীরের গ্লুকোজ প্রয়োজন; কারণ এটি আমাদের শক্তি দেয়। এই গ্লুকোজ তখন পাকস্থলীর প্রাচীর দ্বারা শোষিত হয়ে রক্তস্রোতে গিয়ে মিশে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকস্থলীর নিচে অবস্থিত অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নামের হরমোন নিঃসৃত হয়, যা শরীরকে খাবার থেকে শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে। এই ইনসুলিন ও গ্লুকোজ তখন রক্তস্রোতের মাধ্যমে আমাদের শরীরের সব কোষে পৌঁছায়, যেখানে প্রতিনিয়ত শক্তি প্রয়োজন।
বিষয়টি ভালোভাবে বোঝার জন্য আমরা মাংসপেশির কোষের উদাহরণ দিতে পারি। মাংসপেশির কোষে ইনসুলিন, গ্লুকোজকে কোষের মধ্যে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। এখানে ইনসুলিন অনেকটা চাবির মতো কাজ করে, যা গ্লুকোজের জন্য কোষের দুয়ার খুলে দেয়। অর্থাৎ ইনসুলিন ছাড়া গ্লুকোজ কোষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। এভাবে ইনসুলিনের সহায়তায় রক্তের গ্লুকোজ কোষে চলে যাওয়ার কারণে রক্তস্রোতে গ্লুকোজের মাত্রা কমে আসে। তবে যকৃতে সঞ্চয়কৃত গ্লুকোজ অবমুক্তের মাধ্যমে রক্তস্রোতে গ্লুকোজের মাত্রা আবার বেড়ে যেতে পারে। এর প্রতিক্রিয়ায় আবার ইনসুলিন নিঃসৃত হবে এবং সেই ইনসুলিন আবারও রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে গ্লুকোজকে দেহকোষে পৌঁছে দেবে। শরীর সব থেকে ভালো কাজ করে যখন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকে।
দেহে গ্লুকোজের মাত্রা খুব বেশি বেড়ে যাক বা খুব বেশি কমে যাকÑতা শরীর কখনও চায় না। সাধারণত দেহে একটি পরিক্রমা আছে, যার মাধ্যমে গ্লুকোজের মাত্রা ও ইনসুলিনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে। এটি অর্জিত হয় গ্রহণ করা খাবার, অগ্ন্যাশয় ও লিভারের সমন্বিত ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে। যাহোক, কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এ সিস্টেমটি কাজ করে না। ফলশ্রুতিতে তাদের ডায়াবেটিস দেখা দেয়।
দু’ধরনের ডায়াবেটিস আছে, টাইপ-১, টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে শরীর মোটেও কোনো ইনসুলিন উৎপাদন করে না। এটি একটি অটোমেটিক রেসপন্সের কারণে হয়, যেখানে ইমিউন সিস্টেম অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষকে ধ্বংস করে। আমরা এখনও পরিষ্কারভাবে জানি না ঠিক কী কারণে কার কার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে; আবার অন্যদের ক্ষেত্রে ঘটে না। ১০০ জনের মধ্যে ১০ জন রোগীরই টাইপ-১ ডায়াবেটিস। এটি বেশি দেখা যায় ৪০-এর কম বয়সীদের মাঝে এবং এখন পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে এ ধরনের ডায়াবেটিসই বেশি দেখা যায়। টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে শর্করাজাতীয় খাবার পাকস্থলীতে হজম হয়ে গ্লুকোজে পরিণত হয়। তারপর সেই গ্লুকোজ রক্তস্রোতে মিশে যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় গ্লুকোজকে দেহকোষের মধ্যে প্রবেশ করানোর জন্য এ সময় শরীর ইনসুলিন উৎপন্ন করে। কিন্তু টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে কোনো ইনসুলিন তৈরি হয় না বলে গ্লুকোজ কোষে প্রবেশ করতে পারে না; তার ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। শরীর এই গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে চায়; কারণ নির্দিষ্ট মাত্রা অপেক্ষা কম বা বেশিতে শরীর ঠিকমত কাজ করতে পারে নাÑতা আমরা আগেই জেনেছি। তাই কিডনি দিয়ে অতিরিক্ত গ্লুকোজ বের করে দিতে চায়। যে কারণে যাদের আনডায়াগনজ্ড টাইপ-১ ডায়াবেটিস আছে, তারা ঘনঘন বাথরুমে যান। যেহেতু কিডনি গ্লুকোজকে রক্ত থেকে বের করে আনে, এর সঙ্গে পানিও বের হয়ে যায়। ফলে টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি সহজে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন। যেহেতু ইউরিনে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকে, তাই এটি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। ফলে জেনিটাল ইচিং দেখা যায়। একইভাবে রক্তেও গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকে বলে শরীরের ক্ষত শুকাতে সময় লাগে। এছাড়া গ্লুকোজ চোখের লেন্সে জমা হয়ে লেন্সের মধ্যকার তরলকে ক্লাউডি করে; ফলে সে ব্যক্তি ঝাপসা দেখতে পারেন। যেহেতু গ্লুকোজ কোষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না এবং শক্তি উৎপাদন করতে পারে না; ফলে ব্যক্তি সব সময় ক্লান্ত বোধ করে। কিন্তু স্বাভাবিক কাজের জন্য শরীরে শক্তির প্রয়োজন। এ অবস্থায় শরীর চর্বিকোষ ভেঙে শক্তি উৎপাদন করে বলে ব্যক্তি ওজন হারায়। সুতরাং টাইপ-১ ডায়াবেটিসের প্রধান লক্ষণ হলো, ঘনঘন বাথরুমে যাওয়া, তৃষ্ণা, জেনিটাল ইচিং, ক্ষত দেরিতে শুকানো, চোখে ঝাপসা দেখা, ক্লান্তি ও ওজন কমা। এ লক্ষণগুলো সাধারণত কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেখা দেয় এবং ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা করা হলে লক্ষণগুলো চলে যায়।
সাধারণত ৯০ শতাংশ ডায়াবেটিসই টাইপ-২ ধরনের। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। এ টাইপটি অপেক্ষাকৃত জটিল। এক্ষেত্রে হয় শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপন্ন করতে পারে না; অথবা উৎপন্ন করলেও সেই ইনসুলিন ঠিকমত কাজে লাগাতে পারে না। এটা শরীর মুটিয়ে যাওয়ার কারণে অর্থাৎ শরীরে অতিরিক্ত চর্বি সঞ্চয়ের ফলে হতে পারে। কেননা, সঞ্চিত চর্বি ইনসুলিনকে ঠিকভাবে কাজ করতে দেয় না। তবে এটা সঠিক ওজনসম্পন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও ঘটে। সুতরাং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে শর্করাজাতীয় খাদ্য ডায়জেসটিভ সিস্টেম দ্বারা স্বাভাবিকভাবে ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হয়। এ গ্লুকোজ তখন রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে অগ্ন্যাশয়ে যায়। অগ্ন্যাশয় তখন ইনসুলিন উৎপন্ন করে, যা গ্লুকোজের সঙ্গে রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে সেসব কোষে পৌঁছায়, যেখানে শক্তি উৎপাদনের জন্য গ্লুকোজ প্রয়োজন। তবে সব সময় গ্লুকোজ কোষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। কারণ অতিরিক্ত চর্বি সঞ্চয়ের ফলে কোষের প্রবেশপথগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তার মানে ইনসুলিন ঠিকমত কোষের দরজা খুলতে পারে না। সুতরাং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনবরত বাড়তে থাকে। এর প্রতিক্রিয়ায় অগ্ন্যাশয়ও বেশি বেশি ইনসুলিন উৎপন্ন করতে থাকে। এভাবে একদিকে গ্লুকোজ বাড়ে, তার প্রতিক্রিয়ায় রক্তে ইনসুলিনও বাড়ে এবং এ অবস্থা আরও জটিল হয়। তখন যেসব কোষের শক্তি প্রয়োজন, তারা যকৃত এ ইমারজেন্সি সিগন্যাল পাঠায় যে, ‘সঞ্চিত গ্লুকোজ অবমুক্ত করো’। এভাবে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়তে থাকে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে ইনসুলিন।
টাইপ-১ ডায়াবেটিসের মতো টাইপ-২ ডায়াবেটিসের লক্ষণ হলো ঘনঘন বাথরুমে যাওয়া, তৃষ্ণা পাওয়া, জেনিটাল ইচিং, ওজন হারানো, ক্লান্তি ও চোখে ঝাপসা দেখা। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো খুব ধীরে ধীরে আসে এবং কিছু মানুষের ক্ষেত্রে মোটেই কোনো লক্ষণ থাকে না। এ কারণে অনেক সময় ১০ বছর ধরে টাইপ-২ ডায়াবেটিস থাকার পরও অনেকে বুঝতে পারেন না যে, তার টাইপ-২ ডায়াবেটিস আছে। বিভিন্নভাবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা যায়। প্রথম দিকে খাদ্যাভাস পরিবর্তন, কায়িক পরিশ্রম বা ওজন কমানোই যথেষ্ট হতে পারে। কিন্তু টাইপ-২ ডায়াবেটিস একটি প্রগ্রেসিভ কন্ডিশন এবং বেশিরভাগ লোকেরই কোনো না কোনো ধরনের মেডিক্যাশন প্রয়োজন।
হ জুই ইয়াসমিন, পুষ্টিবিজ্ঞান প্রশিক্ষক