ডিজিটাল বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপ

শহিদুল আলম মজুমদার: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই রচিত হয় একটি আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের ভিত্তি। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি হতে পারে সবচেয়ে বড় অনুঘটক। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদ লাভ করে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ১২ মে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্যাটেলাইটের এলিট ক্লাবের সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এই জাতীয় ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্জন, উপকৃত সকল জনগণ’।

২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিনির্ভর বেগবান বৈশ্বিক উন্নয়নের সঙ্গে সংগত রেখে দারিদ্র্যমোচন করে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদশ গড়তে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দিনবদলের সনদ হিসেবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয় থেকে এবং নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক ভোলা জেলার চর কুকরিমুকরি থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র (ইউআইএসসি) স্থাপন কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। যার বর্তমান নাম ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি)।

এক যুগের বেশি সময় ধরে জনগণের দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছে দিতে বর্তমানে সারাদেশে ৮ হাজার ২৮০টি ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করে ৩০০ অধিক রকমের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে প্রত্যন্ত এলাকার নাগরিকদের যে সেবা সংশ্লিষ্ট দপ্তর হতে গ্রহণ করতে হতো, ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে সহজে কম সময় ও খরচে ডিজিটাল সেন্টার হতে গ্রহণ করতে পারছেন। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়ার এ উদ্যোগ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রশংসিত হয়েছে। ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে ইতোমধ্যে নাগরিকদের প্রায় ৬০ দশমিক ৬৮ কোটির অধিক সেবা প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে ১৬ হাজারেরও অধিক উদ্যোক্তা ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে নাগরিকদের সেবা প্রদান করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে; এর মধ্যে ৮ হাজারেরও অধিক নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন।

ডিজিটাল বাংলাদেশ আসলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপ, যার বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০০৯ সালে। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন দর্শন হচ্ছে দেশের সব মানুষের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশ, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ডিজিটাল অর্থনীতি ও ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ে তোলা। এসব কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নের জন্য আইন, নীতিমালা প্রণয়ন থেকে শুরু করে সামগ্রিক কার্যক্রমের পরামর্শ ও তদারকি করছেন ডিজিটাল বাংলাদেশের আর্কিটেক্ট প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।

কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থানসহ এমন কোনো খাত নেই যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে না। এটা সম্ভব হচ্ছে মূলত সারাদেশে একটি শক্তিশালী আইসিটি অবকাঠামো গড়ে ওঠার কারণে, যা গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমান সরকার দায়িত্ব লাভ করার আগে প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথের দাম ছিল ৭৮ হাজার টাকা। বর্তমানে প্রতি এমবিপিএস ৩০০ টাকার নিচে। দেশের ১৮ হাজার ৫০০ সরকারি অফিস একই নেটওয়ার্কের আওতায়। ৩ হাজার ৮০০ ইউনিয়নে পৌঁছে গেছে উচ্চগতির (ব্রডব্যান্ড) ইন্টারনেট। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতায় মানুষের তথ্যপ্রযুক্তিতে অভিযোজন ও সক্ষমতা দুই-ই বেড়েছে। ঘরে বসেই ফ্রিল্যান্সাররা ব্যবসা পরিচালনা ও  বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে স্বাবলম্বী হচ্ছে।

স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিকাশে আইডিয়া প্রকল্প ও স্টার্টআপ বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডসহ সরকারের নানা উদ্যোগ গ্রহণের ফলে ভালো সুফল পাওয়া যাচ্ছে এবং বর্তমানে দেশে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। ই-গভর্মেন্ট কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশকে প্রায় ২০০ বছর ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের প্রচলিত সেবা প্রদান পদ্ধতির ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। ৫২ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইটের জাতীয় তথ্য বাতায়নে যুক্ত রয়েছে ৯৫ লাখেরও অধিক বিষয়ভিত্তিক কনটেন্ট এবং ৬৮৫টির  বেশি ই-সেবা সহজেই মানুষ অনলাইনে পাচ্ছে। ৮ হাজার ২৮০টি ডিজিটাল সেন্টার থেকে ৬০ কোটির অধিক এবং জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩-এর মাধ্যমে ৭ কোটির বেশি সেবা দেয়া হয়। ডিজিটাল সেন্টার, জাতীয় তথ্য বাতায়ন ও মাইগভ থেকে প্রতি মাসে সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা ৭৫ লাখের বেশি। ২০২৫ সাল নাগাদ যখন শতভাগ সরকারি সেবা অনলাইনে পাওয়া যাবে তখন নাগরিকদের সময়, খরচ ও যাতায়াত সাশ্রয়ের পরিমাণ কী পরিমাণ বাড়বে তা সহজেই অনুমেয়। এ পর্যন্ত ই-নথিতে ১ কোটি ৬৭ লাখ ফাইলের নিষ্পত্তি হয়েছে এবং প্রায় ৪৭ লাখ ৭১ হাজারের অধিক ই-মিউটেশন সম্পন্ন হয়েছে অনলাইনে। ‘ফোর টায়ার ন্যাশনাল ডাটা সেন্টার’ প্রকল্পের আওতায় দেশে একটি সমন্বিত ও বিশ্বমানের ডেটা সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। এর ফলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ই-সেবা সংরক্ষণের ক্ষমতা বৃদ্ধি, ই-সেবাগুলোর সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে জনসেবা আরও উন্নত হবে।

১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৩৯টি হাইটেক/আইটি পার্কের মধ্যে ইতোমধ্যে নির্মিত ৯টিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে। এর মধ্যে ৫টিতে ১৬৬টি প্রতিষ্ঠান ৫৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে ২১ হাজার, মানবসম্পদ উন্নয়ন হয়েছে ৩২ হাজার। নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ১০ হাজার ৫০০ নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব লাভের পর মোবাইল ফোনের মনোপলি ভেঙে তা মানুষের কাছে সহজলভ্য করা হয়।

২০১৫ সালে কম্পিউটার আমদানিতে শুল্ক হ্রাস, হার্ডওয়ার, সফটওয়্যার  শিল্প উৎপাদনকারীদের ভর্তুকি, প্রণোদনা প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেণ গ্রহণ করেন। সরকারের বিভিন্ন নীতি সহায়তার ফলে বর্তমানে দেশে হাইটেক পার্কসহ বিভিন্ন স্থানে স্যামসাং, ওয়ালটন, সিম্ফোনি, মাইফোন, শাওমিসহ দেশি-বিদেশি ১৪টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ উৎপাদন করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে এবং দেশের মোবাইল ফোন চাহিদার ৭০ শতাংশ পূরণ করছে। ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদনে রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে বাংলাদেশ।

ডিজিটাল অর্থনীতির ক্ষেত্রেও দেশে ইতিবাচক ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আইসিটি রপ্তানি ২০১৮ সালেই ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে আইসিটি খাতে রপ্তানি ১ দশমিক ৩ মার্কিন ডলার। অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সারের আউটসোর্সিং খাত থেকে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে।

কভিড মহামারিতে যখন গোটা বিশ্ব টালমাটাল, পরিস্থিতি মোকাবিলায় এমনকি উন্নত দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছিল, তখনও সরকারের বিভিন্ন ডিজিটাল উদ্যোগ মানুষকে দেখিয়েছে নতুন পথ, জুগিয়েছে প্রেরণা। বিগত ১২ বছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যথাযথ অবকাঠামো গড়ে তোলার ফলে কভিডকালে ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠক, আদালতের কার্যক্রম, বিজনেস কনটিনিউটি প্ল্যান অনুসারে অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্যের কার্যক্রমসহ প্রায় সবকিছুই চলমান রাখা হয়। মহামারির মধ্যেও প্রযুক্তির সহায়তায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু থাকায় তা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখছে। প্রযুক্তির সহায়তায় কভিড সচেতনতা, বিভিন্ন দিকনির্দেশনা ও স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ধরনের সেবা দেশের কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে।

দেশব্যাপী লকডাউনে শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম যেন থেমে না যায় সে জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগিতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদরাসা ও কারিগরি পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করা হয়। সংসদ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে দেশব্যাপী সম্প্রচার করা হয়। এ ছাড়া যেকোনো আপৎকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম এবং সরকারি-বেসরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ডিজিটাল মাধ্যমে কার্যকর ও সহজ উপায়ে চলমান রাখতে ‘ভার্চুয়াল ক্লাস’ প্ল্যাটফর্ম চালু রয়েছে।

কভিড মহামারি থেকে দেশের জনগণকে সুরক্ষিত রাখতে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রম, ভ্যাক্সিনেশনের তথ্য সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং সনদ প্রদানের লক্ষ্যে ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ‘সুরক্ষা’ ওয়েবসাইট চালু করা হয়েছে; যা সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং দেশের জনগণ এর সুবিধা পাচ্ছে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের যথাযথ উন্নয়ন ও বিকাশে বিগত প্রায় ১২ বছরের অধিক সময়ে বিভিন্ন কার্যকর ও সময়োপযোগী কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্বপ্ন নয়, বাস্তব। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যে প্রসার ঘটেছে তাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যেই সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপ জ্ঞানভিত্তিক উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০