Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 2:06 am

ডিজিটাল সংযুক্তি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অন্যতম ভিত্তি

ম. শেফায়েত হোসেন: ডিজিটাল সংযুক্তি হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অন্যতম ভিত্তি। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির গৌরবোজ্জ্বল আলোকচ্ছটা গত ১৩ বছরে বাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে ইংল্যান্ড, ভারত, মালদ্বীপ ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের দেশে দেশে উদ্ভাসিত ও অনুকরণীয় হচ্ছে। অতীতের সব পশ্চাৎপদতা অতিক্রম করে ডিজিটাল শিল্পবিপ্লবে বাংলাদেশ আজ নেতৃত্বের যে সক্ষমতা অর্জন করেছে, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে সজীব আহমেদ জয়ের দিকনির্দেশনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সময়োচিত উদ্যোগে ডিজিটাল কানেক্টিভিটির অভাবনীয় এই সফলতা অর্জিত হয়েছে।

বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্বভার গ্রহণকালে বাংলাদেশের টেলিডেনসিটি ছিল ৩০ শতাংশ। বর্তমানে এই হার প্রায় শতভাগে উন্নীত হয়েছে। ২০০৮ সালে যেখানে মোবাইল গ্রাহক ছিল ৪ কোটি ৪৬ লাখ, বর্তমানে তা ১৮ কোটি ২০ লাখ অতিক্রম করেছে। এই সময়ে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক ছিল মাত্র ৪০ লাখ, বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ৯১ লাখ। ব্যান্ডউইডথের ব্যবহার যেখানে ছিল ৭ দশমিক ৫ জিবিপিএস বর্তমানে তা ২৭শত জিবিপিএস অতিক্রম করেছে। ২০০৮ সালে টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত লাইসেন্স ছিল ৬০৮টি, বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে এ সংখ্যা ৩ হাজার ৩৯৬টি। ২০০৮ সালে এক এমবিপিএস ব্যান্ডউইডথ চার্জ ছিল ২৭ হাজার টাকা, যা ২০১৮ সালের পর সর্বনি¤œ ২৮০ টাকা নির্ধারিত হয়। এক দেশ এক রেট কর্মসূচির আওতায় প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেটের মাসিক তা ১০০ টাকায় নির্ধারিত হয়। ২০০৮ সালে ২-জি নেটওয়ার্ক যুগ থেকে বর্তমানে বাংলাদেশ ফাইভ-জি যুগে প্রবেশ করেছে।

২০১৮ সালে বিশ্ব যখন ফাইভ-জি প্রযুক্তি নিয়ে ভাবছে বাংলাদেশ সেই বছরই এই প্রযুক্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ দেশে ফাইভ-জির সফল এই পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। এর আগে ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ফোর-জি বেতার তরঙ্গ নিলাম এবং একই বছর ২০ ফেব্রুয়ারি মোবাইল অপারেটরদের ফোর-জি লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে ফোর-জি সেবা চালু করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ফাইভ-জি যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। ফাইভ-জি প্রযুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসেবে প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো। ফাইভ-জি প্রযুক্তি হচ্ছে একটি শিল্প পণ্য। আগামী দিনের প্রযুক্তি এআই, রোবটিকস, আইওটি, বিগডাটা কিংবা ব্লকচেইনের যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান কিংবা মৎস্য ও কৃষির জন্য ফাইভ-জি অপরিহার্য। এমনকি শিল্প কারখানায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ফাইভ-জি ছাড়া বিনিয়োগ করবে না। এজন্য প্রাথমিকভাবে দেশের পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ফাইভ-জি সংযোগ দেয়ার জন্য বিটিসিএল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।

১২ মে ২০১৮ বাংলাদেশের প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। এরই মধ্য দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশ অভিষিক্ত হলো ৫৭তম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের মর্যাদায়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ সুবিধার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ২০২৩ সালের মধ্যে এটির কার্যক্রম চালু করার চেষ্টা অব্যাহত আছে। দেশের প্রথম স্যাটেলাইটের মাধ্যমে স্যাটেলাইট-নির্ভর সম্প্রচার ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন করে। অন্যান্য প্রকৃতি ও ধরনের স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণ একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য ডিজিটাল সংযুক্তির সক্ষমতা সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ জাতীয় জীবনের জন্য আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হতে যাচ্ছে ।

কুয়াকাটায় দ্বিতীয় সাবমেরিন কেব্ল সংযোগের পর দেশের তৃতীয় সাবমেরিন কেব্লের বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বহুল প্রত্যাশিত তৃতীয় সাবমেরিন  কেব্ল স্থাপন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সি-মি-উই ৬ কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড মেইনটেনেন্স এগ্রিমেন্ট এবং কনসোর্টিয়ামের সরবরাহকারীগণের সঙ্গে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে তৃতীয় সাবমেরিন কেব্লে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

১৫০ টাকায় বিটিসিএল ল্যান্ড ফোনে যত খুশি তত কথা বলা চালু লাইনরেন্ট মওকুফ এবং ৫২ পয়সা মিনিটে অন্য অপারেটরে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট এই সেবাটি চালু করা হয়। বিনামূল্যে দেশের ৫৮৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফ্রি ওয়াইফাই জোন স্থাপনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় দ্বীপ, চর ও হাওর অঞ্চলসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ডিজিটাল কানেক্টিভিটি পৌঁছে দিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ কাজ করার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের অর্থে ইতোমধ্যে দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলের ৬৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ডিজিটাল শিক্ষার কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এরই মধ্য দিয়ে দেশে ডিজিটাল শিক্ষা বিস্তারের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতে চলেছে। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ফাইবার অপটিক্যাল কেব্ল সম্প্রসারণ করা হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, হাওর, পাবত্য অঞ্চলের দুর্গম পাহাড় উপকূলীয় ও দ্বীপ এলাকায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত হচ্ছে।

২০২১ সালে আইএসপি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এর ফলে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ইন্টারনেটের একদেশ একরেট নির্ধারণ করা হয়েছে। ৬ জুন ২০২১ আনুষ্ঠানিকভাবে একদেশ এক রেট চালু করা হয়। কভিডকালে মানুষের জীবনযাত্রা সচল রাখতে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত শতভাগ টাওয়ার ফোর-জি নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। দেশ ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদন ও রপ্তানি শুরু হয়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও অবকাঠামো ব্যবস্থাপনায় বিপুল ব্যয়ের পাশাপাশি টাওয়ারের অনিয়ন্ত্রিত সংখ্যা, ভূমি ও বিদ্যুতের সংকট ছাড়াও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাবের বিভিন্ন দিক বিবেচনায় মানসম্মত টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর ৪টি কোম্পানিকে এ লাইসেন্স দেয়া হয়। টাওয়ার শেয়ারিং লাইসেন্সের ফলে মোবাইল টাওয়ার লাইসেন্স রোল আউটের ওপর ভিত্তি করে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো কোনো নতুন টাওয়ার স্থাপন করতে পারবে না। এছাড়া এক অপারেটর আরেক অপারেটরের কাছে আর টাওয়ার ভাড়া দিতে পারবে না। কিন্তু লাইসেন্স পাওয়া টাওয়ার কোম্পানির কাছে তাদের টাওয়ার বিক্রি করতে পারবে।

মোবাইল ফোন ও নেটওয়ার্ক এখন মানুষের জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রযুক্তিবান্ধব বিনিয়োগ নীতির ফলে দেশে বর্তমানে মোবাইল ফোনের চাহিদার ৬৩ শতাংশই বাংলাদেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। স্যামসাং ও শাওমিসহ দেশে ১৪টি মোবাইল কোম্পানি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে মেড-ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ডের ফাইভ-জি মোবাইল রপ্তানি করছে। মোবাইল ফোন এবং এর বিভিন্ন অ্যাপসের ব্যবহার, উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, ওভার দ্য টপ (ওটিটি) অ্যাপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্যাটেলাইটসহ আধুনিক টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি দেশের জনগণের জীবনকে সহজ ও সাবলীল করেছে। ডিজিটাইজেশনের প্রসারের পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর।

সামাজিক যোগাযোগনির্ভর কিছু গুজব রটানো অথবা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিষয়টি একটি দিক মাত্র। লেনদেন, ব্যক্তিগত তথ্য থেকে শুরু করে সব কিছু যখন ডিজিটাল তখন আমার তথ্যের নিরাপত্তা যদি দিতে না পারি, তাহলে ডিজিটাইজেশন তো উল্টো আমার জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এই অবস্থার উত্তরণে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের আইনের আওতায় যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়ার সুযোগ রয়েছে, সেগুলো সরকার নিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রেও আমরা প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করেছি। সরকার ইচ্ছা করলে এখন ফেসবুকের ছবি বন্ধ করতে পারবে, ফেসবুকের ভিডিও বন্ধ করা সম্ভব। ইউটিউবের লাইভ ফেসবুকের লাইভ বন্ধ করাও সম্ভব।

টেলিযোগাযোগ সুবিধাবঞ্চিত হাওর, দ্বীপ ও দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি স্থাপনে সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল (এসওএফ) ১৫২৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে আইসিটি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ৫০৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে টেলিযোগাযোগ সুবিধাবঞ্চিত এলাকাগুলোয় ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি স্থাপন, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে দ্বীপ এলাকায় নেটওয়ার্ক স্থাপনে ৪৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, টেলিটকের মাধ্যমে ৩৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে হাওর ও দ্বীপাঞ্চলে ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক স্থাপন, বিটিসিএলের মাধ্যমে ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে হাওর-বাঁওড় ও প্রত্যন্ত ব্রডব্যান্ড ওয়াই ফাই নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ চলছে।

২০৪১ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের বিশটি উন্নত দেশের কাতারে শামিল হবে। সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণের এ অভিযাত্রায় তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের নিরন্তর এ পথ চলা আরও গতিময় হোক, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নের সোনার বাংলা হোক, এটিই প্রত্যাশা।

পিআইডি ফিচার