Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 1:14 pm

ডিপিএস গ্রাহকের সঞ্চয়ী হিসাব থাকার বহুমুখী সুবিধা  

 

জাহিরুল ইসলাম: ডিপোজিট প্রিমিয়াম স্কিমের (ডিপিএস) জন্য সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে বাধ্য করছে ব্যাংক এ শিরোনামে গত বুধবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে শেয়ার বিজে। কয়েকটি ব্যাংকের উদাহরণ দেখিয়ে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ডিপিএস হিসাবধারীদের জিম্মি করে সঞ্চয়ী হিসাব বাড়িয়ে তার মাধ্যমে মুনাফার ধান্দায় এসব ব্যাংক।’ এ থেকে মনে হতে পারে, ডিপিএস খোলার ক্ষেত্রে কিছু ব্যাংকে গ্রাহককে যে সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে হচ্ছে, তাতে শুধু ব্যাংকের ব্যবসায়িক স্বার্থ যুক্ত; গ্রাহকের কোনো সুবিধা নেই। আসলে বিষয়টি সেরকম নয়। এতে যুক্ত রয়েছে গ্রাহক-ব্যাংক উভয় পক্ষের স্বার্থ; সময় ও অর্থ উভয় দিক থেকেই। এটা অনুধাবনের জন্য বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখা দরকার।

সঞ্চয়ী বা চলতি হিসাব থাকলে ডিপিএস গ্রাহক স্ট্যান্ডিং ইনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে ওই হিসাব থেকে নির্ধারিত সময়ে মাসিক কিস্তি জমা দিতে পারেন। এজন্য তাকে প্রত্যেক মাসে ব্যাংকে আসতে হয় না। কোনো কোনো ব্যাংকে ডিপিএসের কিস্তি নির্ধারিত তারিখের মধ্যে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এরপর কিস্তি দিলে গুনতে হয় জরিমানা। স্ট্যান্ডিং ইনস্ট্রাকশন এবং হিসাবে পর্যাপ্ত স্থিতি থাকলে গ্রাহককে এ ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয় না। মোবাইল ফোনে মেসেজ চলে যাওয়ায় গ্রাহক জানতে পারেন, কিস্তি হিসেবে কত টাকা তার হিসাব থেকে ডেবিট হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের সুবিধা হলো, স্ট্যান্ডিং ইনস্ট্রাকশন ও এসএমএসের সার্ভিস চার্জ হিসেবে কিছু আয় হয়। ডিপিএসের কিস্তিও পাওয়া যায় যথাসময়ে। বলা বাহুল্য, এতে গ্রাহকেরও সময় ও ব্যাংকে যাতায়াতের অর্থ বাঁচে। অনেক গ্রাহক রয়েছেন, যাদের ব্যাংকে আসতে হয় দূর-দূরান্ত থেকে। দুই-তিন হাজার টাকা ডিপিএসের কিস্তি হিসেবে জমা দেওয়ার জন্য অনেকে রিকশাভাড়া ব্যয় করেন ৩০-৪০ টাকা। ব্যাংকের আমানতের সুদহার এখন যতটা নিচে নেমেছে, এই অবস্থায় কিস্তি দিতে ব্যাংকে আসার জন্য এ পরিমাণ টাকা ব্যয় কি গ্রাহকের জন্য লাভজনক হবে? এই পরিস্থিতিতে সঞ্চয়ী হিসাব খুলে স্ট্যান্ডিং ইনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে কিস্তি দেওয়াই কিন্তু গ্রাহকের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক। এর সঙ্গে সময়ের মূল্য যোগ করলে লাভের অঙ্ক আরও বেড়ে যায় বৈকি।

ডিপিএসের কিস্তিগুলোর অঙ্ক সাধারণত ছোট হয়ে থাকে। দেখা যায়, এ ধরনের টাকা জমাদানকারীর কারণে ব্যাংকের জমা কাউন্টারের সামনে লাইন হয় দীর্ঘ। ভোগান্তিতে পড়তে হয় অন্য গ্রাহকদের। এ অবস্থায় ব্যাংকের দিক থেকে বিবেচনা করলে সেবার মানোন্নয়ন ও কাউন্টারের সামনের লাইন ছোট রাখতে ডিপিএস গ্রাহকদের সঞ্চয়ী হিসাব থাকাই ভালো। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, পাঁচ হাজার টাকার একটি কিস্তি (অন্য পরিমাণও) কম্পিউটারে পোস্টিং দিতে একজন ক্যাশ অফিসারের যে সময় ব্যয় হয়, পঞ্চাশ হাজার বা পাঁচ লাখের জন্যও ব্যয় হয় একই সময়। পরিচালন ব্যয় যথাসম্ভব কমিয়ে রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হয় ব্যাংককে। এক্ষেত্রে ডিপিএস গ্রাহকের সঞ্চয়ী হিসাব থাকাই ব্যাংকের জন্য লাভজনক। আর গ্রাহকের দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, এ কারণে গ্রাহককেও ব্যয় করতে হয় প্রচুর সময়। প্রতিটি কিস্তি দেওয়ার জন্য কেউ যদি এক ঘণ্টা ব্যয় করেন, ১০ বছর মেয়াদি স্কিমের ১২০ কিস্তি পরিশোধের জন্য তার ব্যয় হবে অন্তত ১২০ ঘণ্টা। আট ঘণ্টা অনুযায়ী কর্মদিবস হিসাব করলে এখানেও তার ব্যয় হবে অন্তত ১৫ কর্মদিবস। সহজে অনুমেয়, বয়স ও শ্রেণিভেদে মানুষের প্রতি কর্মদিবসের মূল্যে ভিন্নতা রয়েছে। কিন্তু কথা হলো, গ্রাহকের সঞ্চয়ী বা চলতি হিসাব এবং তাতে স্ট্যান্ডিং ইনস্ট্রাকশন থাকলে এ বাবদ যে ব্যয় হবে, তা কি ১৫ কর্মদিবসের মূল্যের তুলনায় অনেক কম নয়? এর মাধ্যমেও কি বেঁচে যাচ্ছে না গ্রাহকের অর্থ?

কিছু গ্রাহক রয়েছেন যাদের ডিপিএস হিসাব একাধিক। কোনো ব্যাংকের একই শাখায় পাঁচটিরও বেশি ডিপিএস হিসাব মেইনটেইন করেন, এমন গ্রাহকও দেখেছি বেশ কয়েকজন। বলা বাহুল্য, এসবের নাম্বার ও ভাউচার যথাযথভাবে মেইনটেইন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। দেখা যায়, প্রতি মাসে কিস্তি দেওয়ার আগে তাকে যেতে হয় হেল্প ডেস্কে নাম্বার খোঁজার জন্য। এ ধরনের গ্রাহকদের জন্য সঞ্চয়ী বা চলতি হিসাব থেকে স্ট্যান্ডিং ইনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে কিস্তি প্রদান করাই সুবিধাজনক। তাতে তার নিজের ঝামেলাও কিছুটা কমে। বাস্তবতা হলো, সঞ্চয়ী বা চলতি হিসাব থেকে স্ট্যান্ডিং ইনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে কিস্তি দিলে জমা ভাউচারও সংরক্ষণ করতে হয় না গ্রাহককে। সব কিস্তির হিসাব চলে আসে সংশ্লিষ্ট সঞ্চয়ী বা চলতি হিসাবের বিবরণীতে। এতে কিস্তি জমা দেওয়া নিয়ে গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে মাঝেমধ্যে ভুল বোঝাবুঝির যেসব ঘটনা ঘটে, সেসবের শঙ্কাও কমে যায়।

অনেক গ্রাহক ডিপিএসের মেয়াদ পূরণের আগেই তা ভেঙে ফেলেন। সঞ্চয়ী বা চলতি হিসাব না থাকলে তাকে টাকা প্রদান করতে হয় ডেবিট ভাউচার বা পে-অর্ডারের মাধ্যমে। এ ধরনের ইন্সট্রুমেন্ট ইস্যু করা এবং লেখালেখিতেও খরচ হয় বাড়তি সময়। অনেক সময় গ্রাহক এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, এই সময়টুকু তার কাছে মনে হয় অনেক বেশি। এ ধরনের ইন্সট্রুমেন্টের মাধ্যমে হিসাব বন্ধ করলে নিয়ম অনুযায়ী সেখানে লাগাতে হয় রেভিনিউ স্ট্যাম্প। আর সঞ্চয়ী বা চলতি হিসাব থাকলে এ ধরনের কোনো প্রক্রিয়ায় যেতে হয় না। গ্রাহক হিসাব থেকে টাকা তুলে নিতে পারেন নিজের কাছে থাকা চেকের মাধ্যমে। এটিএম কার্ড থাকলে এ পরিস্থিতিতে টাকা তোলা সম্ভব হয় সেখান থেকেও। কিন্তু সঞ্চয়ী বা চলতি হিসাব না থাকলে এসব প্রক্রিয়া শেষ করে টাকা নেওয়ার জন্য গ্রাহককে আবার যেতে হয় কাউন্টারে। গ্রাহকের দিক থেকে বিবেচনা করলে হিসাব বন্ধ করার জন্য এত সময় ব্যয় কি তার জন্যও লাভজনক? বলা ভালো, অনেক ব্যাংকই কিন্তু ডিপিএস বা মেয়াদি আমানতের মেইনটেন্যান্স বাবদ বার্ষিক চার্জ কাটে না, কাটে শুধু আবগারি শুল্ক ও প্রদত্ত মুনাফা থেকে উৎসে কর। এসব নিয়েও রয়েছে নানা বিভ্রান্তি। হিসাব খোলার সময়ই কোনো ব্যাংক কর্মকর্তা যদি গ্রাহককে এসব বিষয় ভালো করে বুঝিয়ে দেন, তাহলে প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার আস্থা ও সেবার প্রতি সন্তুষ্টি বাড়ে।

চলতি মাসের ১৭ তারিখে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অর্থায়ন প্রতিরোধে তফসিলি ব্যাংকগুলোর জন্য অনুসরণীয় নির্দেশনা দিয়ে যে সার্কুলার জারি করেছে, তাতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, একই ব্যাংকে একই গ্রাহকের একাধিক হিসাব পরিচালিত হলে গ্রাহক পরিচিতির পুনরাবৃত্তি পরিহার ও লেনদেন মনিটরিংয়ের সুবিধার্থে ব্যাংক ওই গ্রাহকের জন্য একটি ইউনিক কাস্টমার আইডেন্টিফিকেশন কোড (ইউসিআইসি) বরাদ্দ করবে। মনে রাখতে হবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা পরিপালনের জন্যও ডিপিএস, ফিক্সড ডিপোজিট বা সেভিংস বন্ডের মতো হিসাব খুলতে আসা গ্রাহককে সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে অনুরোধ করে ব্যাংকগুলো, কারণ প্রত্যেকটি সেভিংস বা লোন প্রোডাক্টের জন্য একটি নতুন করে আইডি খুলতে গেলে গ্রাহককে চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে পড়ে। গ্রাহক পরিচিতির পুনরাবৃত্তির শঙ্কাও তাতে থেকে যায়। অর্থের উৎস যারা গোপন করতে চান, এর মাধ্যমে তাদের আড়ালে থেকে যাওয়ার সুযোগ বাড়ে। সঞ্চয়ী বা চলতি হিসাবের সঙ্গে সংযুক্ত করে ডিপিএস বা অন্যান্য মেয়াদি আমানতের হিসাব খোলা হলে সে শঙ্কাও অনেকটা কমে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ইস্যুতে এখন যেমন কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করছে, এ অবস্থায় প্রতিবেদন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সার্কুলারের নির্দেশনা যথাযথভাবে পরিপালনের জন্য একটি সঞ্চয়ী বা চলতি হিসাবের আওতায় অন্যান্য হিসাব পরিচালনা ছাড়া ব্যাংকগুলোর সামনে ভালো বিকল্প নেই।

তবে এটা ঠিক যে, সঞ্চয়ী বা চলতি হিসাব খুলেই যে এসব বিষয় পরিপালন করতে হবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে রকম কোনো নির্দেশনা দেয়নি। তাই ডিপিএস বা মেয়াদি হিসাব খোলার ক্ষেত্রে গ্রাহককে কোনোভাবে বাধ্য করা যাবে না। এতে প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে গ্রাহকের মনোভাব নেতিবাচক হতে পারে। আমানতের সুদের হার নিম্নমুখী হওয়ার কারণে ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদি আমানত হিসাব খুলতে এখন অনীহা পোষণ করেন অনেকে। তবে গ্রাহককে এটাও মনে রাখতে হবে, ব্যাংকে সঞ্চয় করা এখনও অন্যান্য খাতের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ।

যেসব ব্যাংক সঞ্চয়ী বা চলতি হিসাব ছাড়া গ্রাহককে ডিপিএস বা মেয়াদি আমানতের হিসাব খোলার সুযোগ দিচ্ছে, তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইউনিক কাস্টমার আইডেন্টিফিকেশন কোড-সংক্রান্ত নির্দেশনা কতটা পরিপালন করছে, সেটাও খতিয়ে দেখার বিষয়। ডিপিএস বা মেয়াদি আমানতের হিসাব খোলার ক্ষেত্রে সঞ্চয়ী বা চলতি হিসাব গ্রাহককে বাধ্যতামূলকভাবে মেইনটেইন করতে হবে কি না, এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাও চাচ্ছেন অনেকেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিও হয়তো এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা প্রদান করবে দেশের ব্যাংকগুলোকে। তবে সেক্ষেত্রে গ্রাহক-ব্যাংক উভয়ের স্বার্থই যেন সুরক্ষা হয়, সে ব্যাপারে প্রত্যাশা থাকবে নীতিনির্ধারকদের কাছে। বস্তুত ব্যাংককে বিনিয়োগবহিভর্‚ত আয় করতে হয় গ্রাহককে সেবা প্রদানের মাধ্যমে। গ্রাহককে সেবা না দিয়ে ব্যাংক কিন্তু কোনো আয় করে না। তবে হ্যাঁ, কোনো সেবা বাবদ ব্যাংক সার্ভিজ চার্জ সর্বোচ্চ কত নিতে পারবে, সেটাও হতে পারে আলোচনার ইস্যু। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নীতিমালা বা গাইডলাইন আছে বলে জানা নেই। উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে এ রকম একটি গাইড লাইন প্রদানের ব্যাপারেও ভাবতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উম্মুক্ত বাজারে সেবার মান অনুযায়ী সার্ভিজ চার্জে ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। তবে প্রতিষ্ঠানভেদে একই মানের সেবার দামে যাতে বিস্তর ফারাক না হয়, সেটিই নিশ্চিত করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

 

ব্যাংক কর্মকর্তা

zahirul.duÑgmail.com