Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 5:39 am

  ডিসিসিআই-পিপিআরসি যৌথ সংলাপ: ঢাকার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে জরিপের প্রস্তাব

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে ঢাকা ও মফস্বল এলাকাগুলোর উন্নয়নে যুগপৎ উদ্যোগ নিতে হবে। এসএমই খাতের বিকাশে বিশেষ জোর দিতে হবে। রাজধানীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সিংহভাগই হচ্ছে পুরান ঢাকায়। অথচ সেখানকার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে না। এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) ভবনে ‘ঢাকার অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক স্টেকহোল্ডার ডায়ালগে এসব কথা বলেন বক্তারা। ডিসিসিআই ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) যৌথভাবে এ আলোচনার আয়োজন করে। পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় এ আলোচনায় ঢাকার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্টিন রামা।

বক্তারা বলেন, ট্যানারি ও গার্মেন্টসহ বিভিন্ন খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে যাচ্ছে। নতুন এলাকায় এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য আবাসন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। এ কারণে তারা বিকেন্দ্রীকরণে অনাগ্রহী হচ্ছে। অন্যদিকে ঢাকা থেকে শিল্প-কারখানাগুলো চলে যাওয়ার পর ঢাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভাটা পড়বে কি না, তাও ভাবতে হবে বলে পরামর্শ দেওয়া হয়।

রাজধানীর ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ সম্পর্কে বক্তারা বলেন, ভ্যাট-ট্যাক্স আদায়ের বিষয়ে সরকার তৎপরতা দেখালেও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সরকারি কর্মকর্তাদের আগ্রহ নেই।

আলোচনার উদ্বোধনী বক্তৃতায় ঢাকা চেম্বার সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘রাজধানীতে যানজটের কারণে প্রতিবছর ২০ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। দেশের শহরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০ শতাংশ ঢাকায় বসবাস করে।’ ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমানোর জন্য তিনি এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং সামাজিক সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তার ওপর জোর দেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম ইকোনমিক করিডোরকে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণের একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ঢাকার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করা প্রয়োজন, যা নীতিনির্ধারণী মহলকে তাদের পরিকল্পনা প্রণয়নে সহযোগিতা করবে।’

তিনি বলেন, ‘মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে সমভাবে ঢাকা এবং মফস্বল অঞ্চলের উন্নয়ন একান্ত অপরিহার্য। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশে তৈরি পোশাক খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, তবে অন্যান্য সামাজিক সেবা খাত বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসনের ওপর গুরুত্বারোপের সময় এসেছে।’

এসএমই খাতের বিকাশে সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন এবং পুরান ঢাকার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানান তিনি।

ঢাকার সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নে রাজউক, সিটি করপোরেশন, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয় সভা আয়োজনের প্রস্তাবও করা হয়।

বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্টিন রামা বলেন, ‘বিশ্বের দ্রুত বিকাশমান শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বিভিন্ন সংস্থার অংশীদারিত্বের কারণে ঢাকা শহরের ব্যবস্থাপনায় জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে অবকাঠামো ও সেবা খাতের উন্নয়ন বিঘ্নিত হচ্ছে।’

ঢাকা চেম্বারের সদস্য এমএস সিদ্দিকী বলেন, ‘ঢাকা শহর থেকে সরকারের মোট রাজস্বের ৩৩ শতাংশ সংগৃহীত হয়। অথচ এখানকার অবকাঠামো ও সামাজিক সেবাগুলোর মান কাক্সিক্ষত পর্যায়ের নয়।’

এফবিসিসিআই’র সাবেক পরিচালক আবদুল হক বলেন, ‘সেবা প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর গাফিলতির কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সময়মত সম্ভব হচ্ছে না, পাশপাশি পরিবেশও বিনষ্ট হচ্ছে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রকৌশলী নূর উল্লাহ জানান, অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রাজউক, সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মতো স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সমন্বয় একান্ত অপরিহার্য।

ঢাকা চেম্বারের সদস্য নিয়ামত উল্লাহ মজুমদার বলেন, ‘সরকার রাজস্ব ও ভ্যাট আহরণের ক্ষেত্রে মনোযোগী হলেও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড চালু রাখার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন ও সেবা প্রদানের বিষয়ে খুবই উদাসীন।’

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম ঢাকার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিষয়ে একটি সমন্বিত গবেষণা পরিচালনার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, ‘সরকার কর্তৃক বিশেষায়িত শিল্প এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি ওই অঞ্চলে বসবাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ খাতের উন্নয়ন খুবই আবশ্যক।’

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফর উল্লাহ চৌধুরী সরকারি নীতিমালায় অসঙ্গতি দূরীকরণ এবং একই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানান।

নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নূরুল আমিন দেশের সম্ভাবনাময় তরুণ জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আরও বেশি হারে সম্পৃক্ত করার ওপর জোর দেন।

ডিসিসিআই’র ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি কামরুল ইসলাম, সহ-সভাপতি হোসেন এ সিকদার, পরিচালক  আসিফ এ চৌধুরী, ইমরান আহমেদ, আতিক-ই-রাব্বানী, রাশেদুল আহসান, মহাসচিব এএইচএম রেজাউল কবির প্রমুখ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।