ইসমাইল আলী: ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন করা হচ্ছে আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন করে সরকার। তবে মূল নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। প্রাথমিকভাবে প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে প্রায় ২৪ শতাংশ কম ব্যয়ে প্রকল্পটির ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছিল। ফলে প্রকল্প ব্যয়ে বড় ধরনের সাশ্রয় হয়। পরামর্শক নিয়োগেও ব্যয় কম হয়। সব মিলিয়ে প্রকল্প ব্যয় কমছে।
সম্প্রতি প্রকল্পটির সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (আরডিপিপি) প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছিল ছয় হাজার ৫০৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। তবে সংশোধিত হিসাবে তা কমে দাঁড়াচ্ছে পাঁচ হাজার ৫৮৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। অর্থাৎ নির্মাণব্যয় কমছে ৯২০ কোটি ৭২ লাখ টাকা বা ১৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। যদিও প্রকল্প ব্যয় না কমিয়ে বেঁচে যাওয়া অর্থ অন্য কাজে ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছিল রেলওয়ে, তবে পরে তা বাতিল করা হয়।
ব্যয় কম হওয়ায় প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব প্রণয়ন করেছে রেলওয়ে। শিগগিরই তা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এতে বলা হয়েছে, আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ প্রকল্পের নির্মাণকাজ ও পরামর্শক দুটি প্যাকেজেই অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। ৭২ কিলোমিটার মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর এবং নতুন আরেকটি ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণে চার হাজার ৫৮১ কোটি সাত লাখ টাকা প্রাক্কলিত মূল্যে দরপত্র আহ্বান করেছিল রেলওয়ে। দেশি-বিদেশি মিলে ২৬টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র কিনলেও জমা দেয় মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান।
এতে সবচেয়ে কম দর প্রস্তাব করে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি), বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের জয়েন্ট ভেঞ্চার। এ তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তিন হাজার ৪৭৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা দরপ্রস্তাব করে। ফলে এ কাজে সাশ্রয় হয় এক হাজার ১০৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
একইভাবে প্রকল্পের পরামর্শক কাজের জন্য ২৫৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত মূল্যে দরপত্র আহ্বান করে রেলওয়ে। সর্বনিম্ন দর প্রস্তাব করে কাজটি পায় কোরিয়ার দোহা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড, কোরিয়া রেল নেটওয়ার্ক অথরিটি, জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্টস গ্লোবাল কোম্পানি লিমিটেড, ভারতের বালাজি রেল রোড সিস্টেমস লিমিটেড এবং বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্ট লিমিটেডের জয়েন্ট ভেঞ্চার। তারা প্রস্তাব করে ২৩১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এ দুই কাজে সাশ্রয় হয় এক হাজার ১৩৪ কোটির বেশি।
যদিও নির্মাণকাজ শুরুর পর প্রকল্পটির নকশায় বেশকিছু ত্রুটি ধরা পড়ে। পরে তা সংশোধনে বেড়ে যায় প্রকল্পটির কাজের পরিমাণ। এছাড়া মাটির কাজ প্রায় পাঁচগুণ বেড়েছে। নতুন কিছু অঙ্গ যুক্ত হওয়ায় চুক্তিমূল্যের চেয়ে নির্মাণব্যয় বেশি পড়েছে। পাশাপাশি প্রকল্পটির মেয়াদও কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। এতে পরামর্শক খাতের ব্যয় বেড়ে গেছে। এছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের জন্যও ব্যয় বেড়েছে। তবে সব মিলিয়ে প্রকল্পটিতে ব্যয় চূড়ান্তভাবে সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় ৯২১ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, প্রকল্পটির আওতায় ১৪৪ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ মেইন লাইন এবং ৪০ দশমিক ৬০ কিলোমিটার লুপ লাইন নির্মাণ করা হবে। মেইল লাইনে ১৩২ পাউন্ড ও লুপ লাইনে ৯০ পাউন্ড রেলপাত ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ১১টি স্টেশনের সিগনালিং ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ এবং ১৩টি মেজর ও ৪৬টি মাইনর ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ১১টি স্টেশনের ভবন নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া ৬৮ হাজার ১৯০ বর্গমিটারের ইঞ্জিনিয়ার্স অফিস নির্মাণ করা হচ্ছে।
আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (ইআইবি) দেয়ার কথা ছিল পাঁচ হাজার ৪৭৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। বাকি এক হাজার ২৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করার কথা ছিল। তবে এডিবি ও ইআইবির ঋণের পরিমাণ কমে দাঁড়াচ্ছে চার হাজার ৫০৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আর সরকারের তহবিল থেকে দেয়া হবে এক হাজার ৭৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ সরকারি খাতের ব্যয় কিছুটা বাড়ছে।
এদিকে প্রকল্পটির মেয়াদ প্রাথমিকভাবে ২০২০ সালের জুন ধরা হয়েছিল। তবে তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। নকশায় ত্রুটি, কভিড-১৯ ও বারবার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনকে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, লাকসাম-আখাউড়া রেলপথ ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন উন্নীতকরণ প্রকল্পে এ পর্যন্ত ছয়জন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে সাত নম্বর প্রকল্প পরিচালক দায়িত্বরত আছেন।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরে প্রকল্পটির সাবেক প্রকল্প পরিচালক ও রেলওয়ের বর্তমান মহাপরিচালক ডিএন মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, শুরু থেকেই প্রকল্পটি ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন জটিলতার মধ্যে ছিল। এ কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া নকশায় পরিবর্তন ও কভিডের কারণে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। এজন্য বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে।