ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর যত্নে সচেতন হওয়া প্রয়োজন

মুহাম্মদ ফয়সুল আলম: বছরের বর্ষা মৌসুমে আমাদের দেশে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। এডিস মশার কারণে এ রোগ হয়। তাই মশার কামড় থেকে বাঁচতে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তদের একটি বড় অংশই শিশু। শিশুরা সাধারণত তাদের শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন না বা সতর্ক না হওয়ায় কারণে তাদের ওপর এই রোগের প্রভাব বড়দের চেয়ে আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ অবস্থায় শিশুদের ডেঙ্গু থেকে রক্ষায় মা-বাবা বা অভিভাবকদেরই সচেতনতার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।

দশ বছরের আদরিয়া ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পর চিকিৎসকরা লক্ষ করলেন শিশুটির ব্রেইন, লিভার, হার্ট এবং কিডনিও ঠিকমতো কাজ করছে না । পাঁচদিনের ভেতরে শিশুটির চারটি অর্গান কাজ করা থামিয়ে দিল। কেবল আদরিয়া না আদরিয়ার মতো অনেক শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এবারে ডেঙ্গু তার চরিত্র বদল করেছে। হয়ে উঠছে ভয়ংকর ও মারাত্মক। আর তাতে শিশুরাই আক্রান্ত হচ্ছে বেশি এবং সময়ও পাওয়া যাচ্ছে অল্প। শুরুতেই একাধিক অঙ্গ (অর্গান) আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। আগে যেখানে শিশুদের মধ্যে ৫ থেকে ১০ শতাংশের মস্তিষ্ক ও হƒদযন্ত্রে জটিলতা হতো, এবার সেই হার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ হাজার ১১৫ জন। আর বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এক হাজার ৯৯ জন। আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ৫৯ জন।

সাধারণত ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা কামড় দেয়ার পর সুস্থ ব্যক্তির শরীরে ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশের চার থেকে ১০ দিনের মধ্যে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। তবে ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ আগের চেয়ে এখন অনেকটাই বদলে গেছে। ডেঙ্গু যেহেতু ভাইরাসজনিত রোগ, তাই এই রোগে জ্বরের তাপমাত্রা সাধারণত ১০১, ১০২ ও ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট হতে পারে। তবে ডেঙ্গু হলেই যে তীব্র জ্বর থাকবে, এমনটা নয়। জ্বর ১০০-এর নিচে থাকা অবস্থাতেও অনেক শিশুর ডেঙ্গু হতে পারে। মূলত ডেঙ্গুজ্বরের তিনটি ভাগ রয়েছে প্রথমত. ফেব্রাইল ফেজ শিশুর ডেঙ্গুজ্বর ২ থেকে ৩ দিন বা তার চেয়ে বেশি স্থায়ী হলে; দ্বিতীয়ত. অ্যাফেব্রাইল ফেজে সময় বাচ্চার আর জ্বর থাকে না। সাধারণত এর সময়কাল ২-৩ দিন; তৃতীয়ত কনভালিসেন্ট ফেজ যখন শিশুর শরীরে র‌্যাশ দেখা যায়। এর সময়কাল থাকে ৪-৫ দিন। অ্যাফেব্রাইল ফেজে অভিভাবকদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এই ক্রিটিক্যাল ফেজে শিশুর জ্বর বা শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার পর রোগটি সংকটপূর্ণ অবস্থায় চলে যেতে পারে। এই সময়ে রোগীর শরীরে প্লাজমা লিকেজ হয়ে বিভিন্ন অংশে জমা হয়ে থাকে। এ কারণে রোগীর পেট ফুলে যায় বা রক্তক্ষরণের মতো সমস্যা দেখা দেয় এবং যার কারণে শিশুদের শক সিনড্রোম হতে পারে। তাই জ্বর সেরে যাওয়ার দুই থেকে তিন দিন শিশুকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন অভিভাবকদের।

শিশুদের মধ্যে স্বাভাবিক চঞ্চলতা থাকে না, শিশু নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং ঝিমোতে থাকে। কোনো কারণ ছাড়াই কান্নাকাটি করে। এই সময় শিশুর মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয়, কিছুই খেতে চায় না। বমি বমি ভাব হয় বা কিছু খেলেই বমি করে দেয়। শরীরে লালচে র‌্যাশ দেখা দিতে পারে, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, পেট ব্যথা হতে পারে। শুধু তাই নয়, ৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে শিশুর প্রস্রাব না হওয়া ডেঙ্গুর মারাত্মক লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি। পরিস্থিতি গুরুতর হলে অর্থাৎ ডেঙ্গুর কারণে শিশুর শকে যাওয়ার অবস্থা হলে তার পেট ফুলে যেতে পারে বা শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেমন রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি।

মেডিকেল পরীক্ষায় যদি শিশুর ডেঙ্গু ধরা পড়ে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ডেঙ্গু হলেই যে শিশুকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে বিষয়টা এমন নয়। যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে তাহলে বাড়িতে রেখে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব। শিশুর মধ্যে যদি বিপদ চিহ্ন দেখা দেয়, তাহলে চিকিৎসকরাই তাকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেবেন। শিশুর মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা দিলে চিকিৎসকরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য কিছু পারীক্ষা করাতে পারেন এগুলো হলো কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি), এনএস ওয়ান অ্যান্টিজেন, এফজিপিটি এবং এফজিওটি।

জ্বরের জন্য শিশুকে প্যারাসিটামল ওষুধ দিতে হবে। বারবার গা স্পঞ্জ করে দিতে হবে। প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ দেয়া যাবে না। বমি হলে অ্যান্টিইমেটিক সিরাপ দিতে হবে। শরীরে চুলকানি হলে অ্যান্টিহিস্টামিন সিরাপ দিতে হবে। প্রচুর পরিমাণে তরল জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। ভিটামিন সি জাতীয় খাবার যেমন লেবু, মাল্টা এবং অন্যান্য ফলের রস খাওয়াতে হবে। প্রতিদিন কমপক্ষে ১.৫ থেকে ২ লিটার তরল খাওয়াতে হবে। প্রতিদিন খাবারে দুধ, ডিম, মাছ, মাংস রাখতে হবে।

শিশুদের ডেঙ্গু রোগ হওয়া থেকে বাঁচাতে শুরুতেই এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যেন তাদের মশা না কামড়ায়। এডিস মশার উৎস ধ্বংস করতে হবে। এডিস মশা সাধারণত গৃহস্থালির পরিষ্কার স্থির পানিতে জন্মে তাকে, যেমন ফুলের টব, গাড়ির টায়ার বা ডাবের খোলে বৃষ্টির জমা পানি ইত্যাদি। বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। শিশুদের দিনে ও রাতে মশারির ভেতরে রাখতে হবে। বিশেষ করে নবজাতক শিশুকে সার্বক্ষণিক মশারির ভেতরে রাখা জরুরি। শিশুরা যে সময়টায় বাইরে ছোটাছুটি বা খেলাধুলা করে, সে সময়টায় তাদের শরীরে স্প্রে, ক্রিম বা জেল ব্যবহার করা যেতে পারে। শিশু যদি অনেক ছোট হয় বা তাদের শরীরে ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করা না যায়, তাহলে তাদের হাতে মসকুইটো রেপলেন্ট বেল্ট বা পোশাকে প্যাচ ব্যবহার করা যেতে পারে। মশার কামড় প্রতিরোধে শিশুদের ফুলহাতার জামা ও ফুল প্যান্ট পরিয়ে রাখা যেতে পারে। মশা প্রতিরোধ অ্যারোসল, মশার কয়েল বা ফার্স্ট কার্ড শিশু থেকে শুরু করে সবার জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে। এর পরিবর্তে মসকুইটো কিলার বাল্ব, ইলেকট্রিক কিলার ল্যাম্প, ইলেকট্রিক কয়েল ইত্যাদির সাহায্যে নিরাপদে মশা ঠেকানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরঞ্জামগুলো যেন শিশুর নাগালের বাইরে থাকে, সে বিষয়ে অভিভাবকদের অবশ্যই নজর রাখতে হবে।

কীটতত্ত্ববিদদের মতে, এবার ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য পরিবেশ অনুকূলে থাকায় এ রোগের প্রকোপও বেশি। ম্যালেরিয়া রোগের ক্ষেত্রে সাধারণ মশা যেখানে একজনের বেশি মানুষের দেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে না, সেখানে একটি এডিস মশা ৮ থেকে ১২ জন মানুষের দেহে আক্রমণ করে ডেঙ্গু রোগের সৃষ্টি করতে পারে। তাই এবার এডিস মশার সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে দেশে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপও বেশি।

সরকার প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। সরকার ডেঙ্গু রোগের সুচিকিৎসার জন্য ইতোমধ্যে ৫টি হাসপাতালকে বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে রেখেছেন। এছাড়া সারাদেশের সব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করেছেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছেন। কীটতত্ত্ববিদরা ডেঙ্গু নিয়ে জরিপ করছে। আর সেই জরিপ রিপোর্ট অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে শুধু ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। ডেঙ্গু সচেতনতায় সরকারের পাশাপাশি দেশের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

শেষ কথা হচ্ছে শুধু করোনা নিয়ে থাকলে হবে না, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আরও জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে সুরক্ষার বিষয়ে মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে।

পিআইডি নিবন্ধন

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০