রায়হান উদ্দিন : প্রতিটি রাত পেরিয়ে সূর্যের আলোকরশ্মি পড়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় আরেকটি কর্মমুখর দিন। শুরু হয় নিরন্তর ছুটে চলা। আর ক্লান্ত হয়ে অবসর নেয়া। প্রতিটি ক্ষেত্রে হাসি-কান্না, আনন্দ-বিষাদ, সুখ-দুঃখ নিয়ে মানুষের জীবন। জীবনের দিনগুলো পার করা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের পথচলা। সে সময়গুলো অতিবাহিত পথ চলতে হয়। কিন্তু মানুষের আনন্দ-বিষাদের মধ্যে আরও বিষাদময় করে দিচ্ছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবে মানুষের জীবন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু রোগের পরিস্থিতি ভয়াবহতা ধারণ করেছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটছেন এবং মারা যাচ্ছেন। হাসপাতালে বিপুলসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী। প্রতিনিয়ত হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। নিজ চোখে না দেখলে বোঝা মুশকিল। কত শত শত রোগী প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে। হাসপাতালে ঠাসা ডেঙ্গু রোগী। প্রতিটি কেবিন, ওয়ার্ড এমনকি বারান্দা-করিডোরেও রোগীর ভিড়! স্বজনদের পাশাপাশি চিকিৎসক- স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন রোগীদের সুস্থ করতে। রোগীর ভিড়ের মধ্যে অসহ্য গরমে অনেকেই মশারি ব্যবহার করছেন না। যারা হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা কয়েল জালাচ্ছেন। অথচ ডেঙ্গু রোগীদের অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে বলেছেন স্বাস্থ্য বিভাগ। ডেঙ্গু দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহর থেকে গ্রামাঞ্চলেও। হাসাপাতালে প্রতিদিন নানা বয়সী রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছেন। তাদের এবং তাদের পরিবারের কষ্টের শেষ নেই। এ দুঃখের কথা শুনবে কে? শোনার মতো কেউ কি আছে? যার ডেঙ্গু হচ্ছে বা যাদের পরিবারে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বলতে গেলে যারা নিজের আপনজনদের হারিয়ে ফেলছে ডেঙ্গুর কারণে তারাই জানে কষ্টটা কী। আমরা সাধারণ মানুষ ভয়ে থাকলেও আমরা যাদের ওপর ভরসা করে থাকি তারা কি উপলব্ধি করতে পারছে? তারা কি পদক্ষেপ নিচ্ছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের! তারা সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিচ্ছে তো নাকি পরস্পরের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেকে ঠিক রেখে ঘুমাচ্ছে? তারা কি বুঝতে পারছে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হচ্ছে?
প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রাণহানিও বাড়ছে। প্রতিনিয়ত মানুষের মাঝে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। ডেঙ্গু থেকে বাঁচার জন্য যেমন সচেতনতা দরকার তেমনি অন্যকে সচেতন করা জরুরি। বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু জ্বর শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। সেই থেকে প্রতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছেন অনেকে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরে সারাদেশে মারা যায় ১৭৯ জন। এরপরের বছর ২০২০ সালে ডেঙ্গুতে মারা যায় ৭ জন। তখন বৈশ্বিক মহামারি কভিডের সংক্রমণও ছিল। কভিডের মধ্যে ২০২১ সালে ডেঙ্গুতে মারা যায় ১০৫ জন। আর ২০২২ সালে মারা যায় ২৮১ জন। সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছিল গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে, মোট ৬১ হাজার রোগীর মধ্যে ২৮১ জন মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু প্রতি বছরকে ছাড়িয়ে এ বছর প্রতিদিন অনেক রোগী শনাক্ত হচ্ছে। মারাও যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতার কারণে সে ফল ভোগ করতে হচ্ছে পুরো দেশবাসীকে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহর ছাড়িয়ে এখন গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে। প্রতিদিন ২ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে। ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার আক্রমণ বিস্তার প্রভাব ধারণ করছে। এ মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিপুল অর্থ খরচ করার পরও কর্তৃপক্ষ এডিস মশার কাছে পরাজয় বরণ করতে হচ্ছে।
তথ্য সূত্রে দেখা গেছে, ২০০০ সাল থেকে শুরু করে ২০২২ সাল পর্যন্ত বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ মৃতের সংখ্যা ছিল ২৮১ জন। সেখানে তার বেশি চলতি বছরে আগস্টের মধ্যে তা পেরিয়ে মারা গেছে ৩৪২ জন। আর সেপ্টেম্বরে তা টপকে মারা গেছে ৩৯৬ জন। রেকর্ড ভেঙে রেকর্ড করতেছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। সেপ্টেম্বরের শেষ ১৫ দিনে ছাড়িয়ে গেছে আগস্ট মাসের ভয়াবহতাকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ঢাকায় সাতজন ও ঢাকার বাইরে ছয়জন মারা গেছেন। এ সময় ডেঙ্গু নিয়ে ২ হাজার ৭৯৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর দেশে ডেঙ্গুতে ১ হাজার ৩০ জনের মৃত্যু হলো। আর অক্টোবর মাসের প্রথম ৩ দিনেই এডিস মশাবাহিত রোগে মারা গেলেন ৪১ জন। এমন পরিস্থিতির ফলে ২০১৯ সালের আক্রান্ত এবং ২০২২ সালের মৃত্যুর রেকর্ড ছাড়িয়ে দ্বিগুণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞরা। চলতি বছরের শুরুতে কীটতত্ত্ববিদরা আশঙ্কা করেছিলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে। তখন ডেঙ্গুর সংক্রমণ কম ছিল। কম থাকা অবস্থায় মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা না রাখার কারণে এখন উদ্বেগ হারে বাড়ছে ডেঙ্গুর সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার। চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুতে ব্রাজিলকে টপকে এখন শীর্ষস্থানে বাংলাদেশ। তা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আরো পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ হবে। দরকার হলে ক্রাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। তাহলে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভবপর হবে।
ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত রোগ। এডিস মশার কামড়ে এ রোগ হয়ে থাকে। ডেঙ্গু বিস্তারে ৯০-৯৫ শতাংশ ভূমিকা রাখে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়। এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার বদ্ধ পানিতে হয়। বৃষ্টির পানি জমে এমন স্থানে। বাসার ছাদে জমে থাকা পানিতে, গাছের টব, ফুলদানির টব, পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের ড্রাম, পানির চৌবাচ্চা, খোলা একুরিয়াম, বাসার আশপাশে ময়লা আবর্জনায় জমে থাকা পানি, জমে থাকা নালার পানি ইত্যাদি। এগুলোর বিষয়ে সবচেয়ে সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর একবার হলে এটি থেকে সহজেই আরোগ্য লাভ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। যার দারুণ নিজের এবং পরিবারের ওপর মানসিক অশান্তি সৃষ্টি হয়। ডেঙ্গু জ্বর থেকে রক্ষা পেতে বাড়ির আশপাশে সব জায়গায় পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাড়ির ছাদে বা বাড়ির সামনে বাগান পরিষ্কার রাখতে হবে। বাড়ির কোথাও যাতে পানি জমে না থাকে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। প্রতিবেশীদের সতর্ক রাখতে হবে পরামর্শ দিতে হবে। বাড়ির আশপাশে নালা, ম্যানহোল ঢেকে রাখতে হবে। সবসময় মশার ওষুধ দিতে হবে। বর্তমানে নগরায়নের ফলে শহরের পাশাপাশি উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়নে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। মূলত অপরিকল্পিতভাবে নগরায়নের কারণে বাড়ছে ডেঙ্গু। সচেতনতায় পারে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে। তাই সবাইকে নিজ অবস্থান থেকে, নিজ দায়িত্ববোধ থেকে সচেতন হতে হবে। বাড়ির মধ্যে শিশু থাকলে তাদের যত্ন করবেন সতর্ক অবস্থানে রাখবেন। বাসার মধ্যে মশারি টানাবেন। ঘর থেকে বের হলে হাত, পায়ে কাপড় দেয়ার চেষ্টা করবেন। ডেঙ্গু হলে আতঙ্কিত হবেন না। দুশ্চিন্তা করবেন না, ছোটাছুটি করবেন না। ডাক্তারের পরামর্শ নিন। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু হয়। এডিস মশার কামড়ে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। উপসর্গগুলোর মাঝে রয়েছে জ্বর, জ্বর ১০২ ডিগ্রি থেকে ১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে, এছাড়া মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি ইত্যাদি উপসর্গ রয়েছে। ডেঙ্গু হলে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিন, মাথায় পানি দিন এবং যথেষ্ট তরল খাবার খান। ডেঙ্গুর কোনো ভ্যাকসিন নেই। গত ২ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি ভিত্তিতে জাপানের ওষুধ ও টিকা প্রস্তুতকারী কোম্পানি ফার্মাসিউটিক্যালসের ডেঙ্গু টিকা ‘কিউডেঙ্গা’ কে ব্যবহারের ছাড়পত্র দিয়েছে। টিকা বাজারে আসার আগে সবাইকে সচেতন হতে হবে। জ্বর হলে জ্বর কমার জন্য প্যারাসিটামল খেতে পারেন। কিন্তু দোকান থেকে অ্যান্টোবায়োটিক কিনে খাবেন না, এতে ক্ষতি হতে পারে। তিন দিনের বেশি জ্বর থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। এটি বাঁচার জন্য ভালো হয়। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি। মশা নিধনে জনপ্রতিনিধি, সিটি করপোরেশন, বিভিন্ন সংস্থা সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রত্যেকেই নিজে বাঁচতে দেশের মানুষকে বাঁচাতে নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও নজরদারি বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যসেবায় সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা। এতে করে সবার অংশগ্রহণে কমবে দুর্ভোগ। ব্যক্তিগত উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীকেও সচেতন রাখতে হবে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে নিজে সচেতন হোন, অন্যকেও সচেতন করুন। তাইলেই সম্ভব হবে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে।
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ