মহামারিতে রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু। এ রোগের বাহক এডিস মশা ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হলো
বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায় ঠিকই; কিন্তু চলতি বছর এর হার অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। আতঙ্কের মূল কারণ হিসেবে কিছু ভুল ধারণাকে দায়ী করা হচ্ছে। এ ভুল ধারণা থেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অনেক নিয়ম-কানুন বেঁধে দেওয়া হয়। ফলে রোগীকে পড়তে হয় বিভ্রান্তিতে। এসব সমস্যা দূরীকরণে কয়েকটি বিষয় মেনে চলা যেতে পারে:
স নবজাতকের মায়েরাও ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন। আক্রান্ত মায়েরা তখন শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে সংশয়ে থাকেন। এতে যেমন শিশুর ক্ষতি হয়, তেমনি মায়েরও ক্ষতি হয়। চিকিৎসকের মতে, বুকের দুধে এ ভাইরাস থাকে না। কাজেই আক্রান্ত অবস্থায় মা শিশুকে তার বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন
স অনেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে একত্রে থাকতে চান না বা ভয় পান। এতে রোগী বিভ্রান্তিতে পড়েন। জেনে রাখুন, এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। কাজেই আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে এক বিছানায় শোয়া, একসঙ্গে থাকা-খাওয়া বা রোগীর ব্যবহার্য কোনো জিনিস ব্যবহার করা মূলত কোনো সমস্যা নয়
স জ্বরের প্রাথমিক অবস্থায় ওষুধপত্র ও খাওয়া-দাওয়া নিয়ে নানা বিভ্রান্তিতে পড়তে হয় রোগীদের। যেহেতু এটি ভাইরাসজনিত জ্বর, তাই
প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট। একই সঙ্গে প্রচুর পানি ও শরবত-জাতীয় তরল খাবারও খেতে হবে। খেতে না পারলে প্রয়োজনে শিরাপথে স্যালাইন বা গ্লুকোজ প্রভৃতি দেওয়া যেতে পারে
স ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় রোগী ও চিকিৎসক উভয়েই রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য অতি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু রক্তক্ষরণ যদি না হয় ও রোগীর রক্তের হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক থাকে, তবে রক্ত পরিসঞ্চালনের কোনো প্রয়োজন পড়ে না
স অনেক সময় দেখা যায়, রক্তের প্লাটিলেট কম হলে অনেকে রক্ত নেওয়ার চেষ্টা করেন। এতে কোনো লাভ হবে না। মনে রাখতে হবে, শুধু কম প্লাটিলেট কাউন্টের জন্য রক্ত দেওয়া উচিত নয়। তাছাড়া প্লাটিলেট বৃদ্ধিতে প্রয়োজন খাবার। কিছু খাবার রয়েছে, যেগুলো প্লাটিলেটকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে
স জ্বরের পাঁচ থেকে ছয় দিনে রোগীর স্বাভাবিক প্লাটিলেট কাউন্ট কমতে থাকে। কিন্তু দেখা যায়, দুই থেকে তিন দিন পর তা আপনাআপনি বাড়তে শুরু করে কোনো চিকিৎসা ছাড়াই। অনেক সময় প্লাটিলেট কাউন্ট কমে গেলে রোগী ও চিকিৎসক খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। এ সময় প্লাটিলেট পরিসঞ্চালনের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসক। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্লাটিলেট পরিসঞ্চালনের কোনো প্রয়োজন হয় না
স এক ইউনিট প্লাটিলেটের জন্য চার ইউনিট রক্ত প্রয়োজন হয় ও সেপারেটর দিয়ে আলাদা করতে হয়, যা ব্যয়বহুল। অথচ রক্তে প্লাটিলেটের হাফ লাইফ মাত্র ছয় ঘণ্টা
স অপ্রয়োজনীয় ও তাড়াহুড়ো করে প্লাটিলেট দেওয়ায় হেপাটাইটিস বি অথবা সি, এমনকি এইচআইভি দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বারবার প্লাটিলেট দিলে রক্তের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে। তাই অপ্রয়োজনে প্লাটিলেট দিলে লাভ না হয়ে বরং ক্ষতি হতে পারে। কাজেই প্লাটিলেট দেওয়ার জন্য রোগী ও চিকিৎসকের অযথা চিন্তার কোনো কারণ নেই
স এটি ভাইরাসজনিত রোগ। তাই অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই। তবে মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্য ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগও থাকতে পারে, যেমন টাইফয়েড ফিভার বা অন্য কোনো ইনফেকশন, এজন্য এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন
স ডেঙ্গু কোনো মারাত্মক রোগ নয়। তবে কিছু ভুল ধারণায় মারাত্মক আকার ধারণ করে। ফলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়। সতর্কতা অবলম্বন করলে সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব। তবে এ সময় রোগীকে অভয় দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়
খেতে হবে তরল জাতীয় খাবার
এডিস মশার কারণে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় মানুষ। চলতি বছর দেশজুড়ে এ রোগ মহামারি আকার ধারণ করেছে। এ রোগের কারণে রক্তে অনুচক্রিকার সংখ্যা কমে যায়। এ সময় রোগীর প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরলজাতীয় খাবার। তাই ডেঙ্গু আক্রান্ত সবার খাদ্যতালিকায় পানি বা তরলজাতীয় খাবার রাখতে হবে।
# শুধু যে ডায়রিয়া হলে ডিহাইড্রেশন হয়, তা নয়; ডেঙ্গুজ্বর হলেও ডিহাইড্রেশনের মাত্রা বেড়ে যায়। এ সময় পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। আক্রান্ত শিশুরা বেশি পানি খেতে চায় না। সেক্ষেত্রে তাদের অল্প অল্প করে বারবার পানি খাওয়াতে হবে
# পানির পাশাপাশি লেবুর শরবত খাওয়াতে হবে। কেননা, ভিটামিন ‘সি’ রক্তে প্লাটিলেট বাড়াতে সাহায্য করে। তাই ডেঙ্গু হলে নিয়মিত লেবুর রস খাওয়ানো উত্তম
# আক্রান্ত রোগীকে ডাবের পানি বেশি করে খাওয়াতে হবে। ডাবের পানিতে খনিজ বা ইলেকট্রোলাইটস রয়েছে, যা ডেঙ্গুজ্বর সারিয়ে তুলতে প্রয়োজন
# পেঁপের জুস ডেঙ্গু রোগীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পেঁপে অণুচক্রিকা বাড়াতে বেশ সাহায্য করে। এছাড়া পেঁপে পাতার রসও ডেঙ্গুতে উপকারী। পাতা সেদ্ধ করে সেই পানিও খেতে পারেন
# ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে বিভিন্ন সবজি, যেমন- ব্রোকলি, পালংশাক, গাজর দিয়ে তৈরি সবজির স্যুপ খাওয়াতে হবে। এ ধরনের স্যুপ দুর্বলতা কমিয়ে শরীরে শক্তি জোগাবে ও প্লাটিলেটকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে
# খেজুরের রস এ রোগীর জন্য খুব ভালো। পারলে খেজুর রাতে ভিজিয়ে রেখে সকালে সে পানি পান করতে পারেন
# টাটকা যে কোনো ফলের জুস বানিয়ে খেতে পারেন
# হারবাল চা ডেঙ্গুজ্বরের ঝুঁকি কমায়। এ কারণে জ্বর হলে দারুচিনি, লবঙ্গ ও আদা দিয়ে হারবাল চা পান করানো যেতে পারে
# এ জ্বরে নিমপাতার রস খুব কার্যকরী। তাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে নিমপাতার রস বানিয়ে খেতে পারেন
# বাড়িতে রান্না করা সব ধরনের খাবার ঝোল করে খেতে হবে। ভাজা-পোড়া খাবার এ সময় না খাওয়াই ভালো
টি প স: বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
ডেঙ্গুতে বিচলিত বা আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গত সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো সরকারের এক তথ্যবিবরণীতে এ কথা জানানা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন এবং এগুলো অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছেন। দেখে নিতে পারেন তাদের পরামর্শগুলো।
বাড়িতে চিকিৎসা চলাকালীন সতর্কতা
নিচের যে কোনো একটি লক্ষণ দেখা
দিলে অতিসত্বর হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে।
# জ্বর কমার প্রথম দিন রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি
# বারবার বমি বা মুখে তরল খাবার খেতে না পারা
# পেটে তীব্র ব্যথা
# শরীর ও মুখ বেশি দুর্বল অথবা নিস্তেজ হয়ে পড়া
# হঠাৎ করে অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া
# শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে যাওয়া কিংবা শরীর অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া
বাড়িতে চিকিৎসা
# পর্যাপ্ত বিশ্রাম (জ্বর চলাকালীন ও জ্বরের পর এক সপ্তাহ)
# স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে তরলজাতীয় খাবার খাওয়া, যেমন- খাবার স্যালাইন
# গ্লুকোজ, ভাতের মাড়, বার্লি, ডাবের পানি, দুধ, বাসায় তৈরি ফলের রস,স্যুপ প্রভৃতি।
জ্বর থাকাকালীন চিকিৎসা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট
# পূর্ণবয়স্কদের জন্য দুটি করে প্রতি ছয় থেকে আট ঘণ্টা পরপর
# শিশুদের জন্য বয়স ও ওজন অনুসারে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী
# জ্বর থাকাকালীন রোগী দিনরাত সব সময় মশারির ভেতরে থাকবে
জ্বর থাকাকালীন যেসব ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে
# ব্যথানাশক ওষুধ (এনএসএআইডি গ্রুপ, যেমন- ডাইক্লোফেন, আইবুপ্রোফেন, ন্যাপারক্সেন, মেফেন)
# অ্যাসপিরিন/ক্রোপিডোপ্রেল (অ্যান্টি প্লাটিলেট গ্রুপ) হৃদরোগীদের জন্য জ্বর থাকাকালীন ও প্লাটিলেট হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে
# ওয়ারফারিন (অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট) হৃদরোগীদের জন্য জ্বর থাকাকালীন ও প্লাটিলেট হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে
# অ্যান্টিবায়োটিক-জাতীয় ওষুধ (বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিরেকে)
স কুসুম গরম পানি বা নরমাল তাপমাত্রার পানি দ্বারা সারা শরীর মোছা (এক্ষেত্রে ঠাণ্ডা পানি দেওয়া)
# বাড়ি ও এর আশেপাশের এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল নিশ্চিহ্ন করা ও মশার আবাসস্থলে স্প্রে করা।
সেরে ওঠার পর পরিচর্যা…
চিকিৎসকদের মতে, এ বছরের ডেঙ্গুর লক্ষণ আগের বছরগুলোর মতো নয়। প্রবণতাও ভিন্ন। এবার যাদের ডেঙ্গু হয়েছে, তাদের জ্বর খুব একটা বেশি উঠছে না। উঠলেও দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে নেমে যাচ্ছে। অতীতে প্রচণ্ড জ্বর হতো যার নাম ‘হেমোরেজিক ফিভার’। এবার কিন্তু এমন হচ্ছে না। এবার যা হচ্ছে, চিকিৎসকরা তার নাম দিয়েছেন ‘শকড সিনড্রোম।’ এ কারণে এবার অল্প জ্বর হলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
এবার তিন থেকে চার দিনে জ্বর কমে আসার পরই মূলত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর জটিলতা বেশি দেখা যাচ্ছে। জ্বর চলে গেলে ভাইরাসটিও ধীরে ধীরে বিদায় নিতে থাকে। তবে কমে গেলেও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
পাতলা পায়খানা হচ্ছে কি না কিংবা বুক বা পেটে কোনো ব্যথা হচ্ছে কি না, সেদিকে নজর রাখতে হবে।
ফ্লুয়িড ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ তরল খাবার খাওয়াতে হবে। তাহলে ডেঙ্গু নিয়ে ভয়ের কিছু থাকবে না। এজন্য প্রয়োজনীয় স্যালাইনের পাশাপাশি ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস, পানি প্রচুর পরিমাণে পান করতে হবে। একই সঙ্গে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে।
ডেঙ্গু যেন সঙ্গী না হয়
ডেঙ্গুর প্রকোপ দীর্ঘদিন ঢাকাভিত্তিকই ছিল। কয়েক বছর ধরে বর্ষার শুরু থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকার হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীতে সয়লাব হয়ে থাকে। তবে এবার মহানগরীর বাইরেও এ মশাবাহিত ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। দেশের বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এমনই জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা এখনও শহরকেন্দ্রিক। এ মশা সাধারণত ১০০ থেকে ৪০০ মিটারের বেশি উড়তে পারে না। তবে পরিবহনের মাধ্যমে এরা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এটাই আশঙ্কা ছড়াচ্ছে এ কারণে যে, ঈদুল আজহায় অনেক মানুষ ঢাকা ছেড়ে বাড়িতে যাবে। তাহলে কি ডেঙ্গু রোগীর বাহকের মাধ্যমে আরও ছড়িয়ে পড়বে রোগটি? ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে দেশ?
উল্লিখিত কারণে বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য জ্বর
নিয়ে ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছেন।
জ্বর থাকলে যেন পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন কি না।
দেশজুড়ে ডেঙ্গুবিষয়ক সচেতনতা কর্মসূচি চলছে। ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু ধরা পড়লে করণীয় সম্পর্কে দেশের সব স্থানে গাইডলাইন পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের পুনঃপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।