প্রকৃতিতে এখন বর্ষাকাল। ভোর, সাঁঝ কিংবা গভীর নিশি নেই, অঝোর বারিধারায় কেবলই বর্ষণ। অনিন্দ্যসুন্দর এই বর্ষার আগমনের সঙ্গে প্রায়ই অনুষঙ্গ হয়ে আসে নানা ধরনের রোগব্যাধি। আর এসব রোগব্যাধির মধ্যে ডেঙ্গু উল্লেখযোগ্য। মূলত বর্ষার শুরু থেকেই এই রোগের উপদ্রব দেখা দেয়। তাই বছরের অন্য সময়ের চেয়ে এই সময়টাতে একটু বেশি সতর্কতা প্রয়োজন।
ডেঙ্গু মূলত মশা-পরিবাহিত রোগ, যা এডিস মশার কামড়ে হয়ে থাকে। সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। তবে জুন থেকে সেপ্টেম্বরÑএই চার মাস মূল মৌসুম। বৃষ্টিপাত, জলাবদ্ধতা ও বাতাসে অত্যধিক আর্দ্রতা এ মশার বংশবিস্তারে সহায়ক। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দ্রব্যাদি, গাড়ির চাকার টায়ার, বাড়ির পানি সংগ্রহের ট্যাংক, ফুলের টব ও ফুলদানিতে জমে থাকা পানিতে এ মশা বংশবিস্তার করে। এদের ডিম ফোটার জন্য পানির প্রয়োজন হয় বলে বর্ষা মৌসুমে এ মশার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। তাই এ সময়টাতে বাড়ি ও তার চারপাশ নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে।
গত বছরের সকল পরিসংখ্যান ছাপিয়ে এ বছর রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। স্বস্তির বিষয় হলো, চলতি বছর ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যু হয়নি। গত বুধবার শেষ হওয়া জুন মাসে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ২৭১ জনের, যা চলতি বছরে মোট শনাক্তের ৬৯ শতাংশ। গত বছরের জুন মাসে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছিল ২০ জনের। সে হিসাবে গত বছরের জুন মাসের তুলনায় এবারের জুন মাসে রোগী বেড়েছে সাড়ে ১৩ গুণ। ২০২০ সালে সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১ হাজার ৪০৫ জন।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের এখন থেকেই আগাম সতকর্তা অবলম্বন করতে হবে। মশার প্রজনন ক্ষেত্র বা ডিম পাড়ার স্থান ধ্বংস করতে হবে। বড় বড় ভবনের আশপাশ, কোনায় কোনায়, ডাস্টবিন ও এর আশপাশের স্থান; এমনকি ঘরের পাতিল, বদনা এসব স্থানেও যেন চার-পাঁচদিনের বেশি পানি জমে না থাকে সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। এডিস মশা দিনের বেলা কামড়ায়। তাই দিনের বেলা ঘুমালে মশারি ব্যবহার করতে হবে। বাসাবাড়ি, হাসপাতাল, অফিস-আদালতের আনাচ-কানাচে মশার স্প্রে বা ওষুধ ছিটাতে হবে; যাতে এসব স্থানে কোনোভাবেই মশা আশ্রয় নিতে না পারে। ঘরের দরজা, জানালা ও ভেন্টিলেটরে মশানিরোধক জাল ব্যবহার করতে হবে। বাচ্চাদের স্কুলের ড্রেসে ফুলহাতা শার্ট, ফুলপ্যান্ট ও মোজা পরালে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমানো সম্ভব। ঘর-বাড়ি ও এর চারপাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা ক্যান, টিনের কৌটা, মাটির পাত্র, বোতল, ডাবের খোসা ও এ-জাতীয় পানি ধারণ করতে পারে এমন পাত্র ধ্বংস করে ফেলতে হবে, যেন পানি জমতে না পারে। গোসলখানায় বালতি, ড্রাম, প্লাস্টিক ও সিমেন্টের ট্যাংক কিংবা মাটির গর্তে পাঁচদিনের বেশি কোনো অবস্থাতেই পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। পরিষ্কার ও স্থবির পানিতে ডেঙ্গুর জীবাণু বেশি জন্মায়। অব্যবহৃত গাড়ির টায়ারে যাতে পানি জমতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। ফ্রিজের নিচে, এসির নিচে, ফুলের টবে ও মাটির পাত্রে সামান্য পানি জমে থাকলে তা-ও নিষ্কাশন করতে হবে।
সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেয়ার পর আবারও জ্বর আসতে পারে। এর সঙ্গে শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, চেখের পেছনে ব্যথা এবং চামডায় লালচে দাগ (র?্যাশ) হতে পারে। ডেঙ্গুজ্বরের তিনটি ভাগ রয়েছে। এ ভাগগুলো হচ্ছে ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘সি’। প্রথম ক্যাটেগরির রোগীরা নরমাল থাকে। তাদের শুধু জ্বর থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী ‘এ’ ক্যাটেগরির। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ‘বি’ ক্যাটেগরির ডেঙ্গু রোগীদের সবই স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন পেটে ব্যথা হতে পারে, বমি হতে পারে প্রচুর কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তি কিছুই খেতে পারে না। অনেক সময় দেখা যায়, দুদিন জ্বরের পর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই ভালো। ‘সি’ ক্যাটেগরির ডেঙ্গুজ্বর সবচেয়ে খারাপ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ’র প্রয়োজন হতে পারে।
যেহেতু ডেঙ্গুজ্বরের প্রধান কারণ হচ্ছে এডিস মশা, সেহেতু এডিস মশা নিয়ন্ত্রণই হচ্ছে ডেঙ্গু প্রতিরোধ তথা তার প্রকোপ কমানোর প্রধান উপায়। তাই এখন থেকেই সরকারের পাশাপাশি স্ব স্ব ব্যক্তিকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আগাম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আগাম সতর্ক হয়ে সহায়ক ব্যবস্থা গ্রহণই এই ডেঙ্গু প্রতিরোধের একমাত্র হাতিয়ার।
মেহেদী হাসান অর্ণব
শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা