শেখ সায়মন পারভেজ : তরুণ প্রজন্মের মোবাইল আসক্তি যেন কোনো এক ভূতের গল্পের খলনায়কের চরিত্র। ভূত যেমন উড়ে এসে জুড়ে বসে, তেমনি মোবাইল আসক্তি তরুণ প্রজন্মের বিকশিত হওয়ার পথে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। এই মোবাইল আসক্তির প্রথম জোগানদাতা ফেসবুক, ইউটিউব ও গেমসের কথা না বললেই নয়। এসব সাইটের আসক্তির পেছনের গল্পে রয়েছে ডোপামিন নামের এক বিশেষ নিউরো ট্রান্সমিটারের কারসাজি।
প্রথমেই জানা দরকার ডোপামিন ও ডোপামিন ডিটক্স কী? ডোপামিন এক ধরনের নিউরো ট্রান্সমিটার, যা মস্তিষ্ক থেকে উৎপন্ন হয়। এই ডোপামিন ক্ষরণ আমাদের মোটিভেশন, আত্মবিশ্বাস, ইচ্ছা, আগ্রহ, প্রত্যাশা ও নিজের ভালো লাগার প্রতি বিশেষ সাড়া দেয়। বর্তমানে ফেসবুক ও ইউটিউবের কনটেন্ট মেকানিজম এই ডোপামিন ক্ষরণের প্রতি লক্ষ রেখে করা হয়। এসব অ্যাপের মূল লক্ষ্য থাকে কম সময়ে কে কত বেশি ডোপামিন নিঃসরণ করতে পারছে। যে যত বেশি নিঃসরণ করতে পারবে, তার অ্যাপের প্রতি ব্যবহারকারীর আসক্তি তত বেশি হবে। ভিন্নভাবে ডোপামিন ছিনতাই থেকে রক্ষা পাওয়ার বিপরীত প্রক্রিয়া হলো ডোপামিন ডিটক্স।
ঘুম থেকে ওঠামাত্রই ফেসবুক নোটিফিকেশন চেক করা আজকাল সবার দৈনন্দিন জীবনের রুটিন। কিন্তু এই নোটিফিকেশন ডোপামিন অতিরিক্ত ক্ষরণের প্রবণতাকে প্রভাবিত করে। আমি একটি কাজ করেছি এবং প্রতিদানের জন্য অপেক্ষা করাই স্বাভাবিক। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি প্রতিদান না পাব, আমার মনস্থির হবে না এবং প্রতিদান না পাওয়া পর্যন্ত অন্য কাজের প্রতি কোনোক্রমে আমার মনোযোগ আসবে না। তেমনি নোটিফিকেশন হলো প্রতিদানের মতোই। কেননা আমি জানি না নোটিফিকেশনে আমার জন্য ভালো নাকি মন্দ বার্তা আছে। অপেক্ষমাণ এই ন্যানো সেকেন্ডে মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন দ্রুত ক্ষরণ হয়। আর ডোপামিন যত বেশি ক্ষরণ হবে তত ওই বিষয়ের প্রতি ভালো লাগা কাজ করবে। ফলে দেখা যায় নোটিফিকেশন চেক করার মাধ্যমে আমি ঢুকে যাচ্ছি ফেসবুক জগতে। তারপর ক্রমেই আমার পছন্দনীয় ভিডিও বা শেয়ার লাইক কমেন্ট প্রাপ্তি আমার মধ্যে এক প্রকার আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করে। এই আকাক্সক্ষাই ডোপামিনের ক্ষরণকে বাড়িয়ে দেয়। ফলে ব্যবহারকারীর মোবাইলে আসক্তি হওয়াই স্বাভাবিক। এই আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রধান উপায় ডোপামিন ডিটক্স।
টেলিভিশনের একটি বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখা যায়। গেমস আসক্তির অভিযোগে এক শিশু বিচারকের কাঠগড়ায়, বিচারপ্রার্থী মা-বাবা, যখনই অপরাধ সাব্যস্ত হওয়ার পথে তখনই শিশুর জবানবন্দিতে উঠে আসে আসল আসামির পরিচয়। নিস্তব্ধ নির্বাক বিচারালয় কালের সাক্ষী হয়ে পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজকে আসল আসামি হিসেবে জানান দিচ্ছে। বিষয়টি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে চিন্তা করলে এতে সমাজ-সংসারের অনেক কিছুর ব্যর্থতা অনুধাবন করা যায়। শিশুদের মোবাইল ফোনে আসক্তির অন্যতম কারণ গেমস। কোমলমতি শিশুদের গেমস একটি এক ধরনের ভালো লাগা, কিন্তু এই ভালো লাগাটা আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। ভালো লাগাটা স্বর্গে নেয়ার পরিবর্তে নরককে আছড়ে দেয়ার মতো। যদিও আমাদের পরিপক্ব জীবনে শিশুদের এই ভালো লাগাটা নিছক কিংবা নগণ্য বটে; কিন্তু ছোট্ট শিশু-কিশোরদের ছোট্ট জীবনে এই ভালো লাগাটা কিন্তু লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদের প্রেম তথা ভালো লাগা থেকে কোনো অংশে কম নয়। যদিও এ অতি ভালো লাগা তথা আসক্তি ভবিষ্যতে পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের জন্য প্রতিবন্ধক।
মোবাইল ডিভাইসে আসক্তি বর্তমানে আমাদের তরুণ প্রজšে§র মূল্যবান সময়কে নষ্ট করছে। কয়েক দিন আগে একটি পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। একটি ছেলে রেললাইনের পাশে গেমস খেলার সময় ট্রেনের হর্নের প্রতি তার মনোযোগ ছিল না বলে ট্রেনে কাটা পড়ে ছেলেটির মৃত্যু হয়। ঘটনাটির পেছনে একটু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করি। ছেলেটি যখন গেমস খেলছে, তখন তার ডোপামিন ক্ষরণ দ্রুত হচ্ছিল। এমনভাবে দ্রুততার সঙ্গে ক্ষরণ হচ্ছিল যে অন্য বিষয়ের প্রতি তার মনোযোগ দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। আর এমন হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে ট্রেনের কাটায় পড়ে। একটু স্বাভাবিকভাবে বিষয়টা চিন্তা করি। যেখানে মোবাইল আসক্তি জীবনের তোয়াক্কা করছে না, সেখানে সময়ের সদ্ব্যবহার বা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন তো বৃথা। অতএব বুঝতেই পারছেন আমাদের নবীন তরুণ প্রজšে§র ভবিষ্যত কোন গঙ্গায় পতিত হচ্ছে।
মোবাইল আসক্তির বড় একটি কারণ ছিল কভিডকালীন পড়াশোনার বাহানায় মোবাইল ফোন কেনা। যদিও কেনার উদ্দেশ্য সাধুবাদ পাওয়া যোগ্য; তবে অভিভাবকের লাগামহীন স্বাধীনতা দেয়াও কাম্য নয়। অভিভাবকের নূন্যতম দায়িত্ব ছিল সন্তানের এই মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রতি নজর রাখা ও কিছু সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করা। এই খামখেলিতে মোবাইল আসক্তিতে আজ আমাদের সমাজ আক্রান্ত। ফলে অভিভাবকের দায় সবচেয়ে বেশি। সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে এ ক্ষেত্রে দায় ফেলে দেয়ার মতো নয়।
এখন মোবাইল আসক্তি থেকে বাঁচতে কী করতে হবে! এ ক্ষেত্রে ডোপামিন ডিটক্সের কথা ভাবা যায়। ডোপামিন ডিটক্সের প্রথম পদক্ষেপ ফ্রিকশন যোগ করা। ফ্রিকশন যোগ করা মানে কাজকে জটিল করা। যেমন মনে করি, আমি পড়তে বসেছি, আমার সামনে মোবাইল ফোন থাকলেই বাটন টিপতে মন চাইবে। এখন আমি যদি আমার মোবাইল ফোনটি পড়ার টেবিল থেকে সামান্য দূরে রাখি, তখন আমার মস্তিষ্ক ওই সামান্য দূর থেকে মোবাইল হাতে নেয়াকে জটিল মনে করবে। তখন ওই মোবাইল ব্যবহার করার আকাক্সক্ষাকে বাদ দিয়ে টেবিলে বসে থাকাকে সমর্থন করবে। ফলে আমি নির্দিষ্ট এই কাজে মনোযোগী হতে পারব। ডোপামিন ডিটক্সের দ্বিতীয় পদক্ষেপ মোবাইল ফোনের নোটিফিকেশন বন্ধ করা।
নোটিফিকেশন মূলত ব্যবহারকারীর মস্তিষ্ককে তাৎক্ষণিক সাড়া দেয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। ফলে মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন নিঃসরণ হয়। এজন্য আমাদের উচিত মোবাইল ফোনের নোটিফিকেশন বন্ধ করে রাখা। ফলে আমাদের মস্তিষ্ক বাড়তি কোনো সংকেত দ্বারা তাড়িত হবে না।
ঘুম থেকে এটা মাত্রই ফোন হাতে নেয়া আমাদের সারাদিনের কার্যপ্রণালীকে অন্যদিকে নেয়ার চেষ্টা করে। তাই উচিত হবে, ঘুম থেকে ওঠামাত্রই নিজ কাজে মনোনিবেশ করা। সেই সঙ্গে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়াÑআজকে সারাদিন কী কী কাজ করব। তাহলে আমার মস্তিষ্ক সেই রুটিন অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করবে।
একদিন সারাদিন আমি মোবাইল ফোন ছাড়া থাকলে দেখব কিছুই ভালো লাগছে না, মন অস্থির অস্থির লাগছে, কাজে মন বসছে না। যত সমস্যাই হোক সম্পূর্ণ একদিন মোবাইল ফোন ছাড়া থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তখন দেখা যাবে, আমাদের মস্তিষ্ক কোনো না কোনো দিকে ডোপামিন ক্ষরণের জন্য আমাদের তাগিদ দেবে। তখন আমরা যে কাজই করব, ওই কাজে ডোপামিন ক্ষরণ হবে, যা ওই কাজের প্রতি ভালো লাগার সৃষ্টি করবে।
অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। আর অবসর সময়ে মোবাইল ফোন মানুষের সঙ্গী হয়ে ওঠে। আমাদের প্রত্যেকের উচিত এই অবসর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার না করে বই পড়া, গল্প করা, ব্যায়াম করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো প্রভৃতি কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। দেখা যাবে মোবাইল আসক্তি আমাদের কাছ থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। এভাবে কয়েক দিন চেষ্টা করি, দেখব ডোপামিন ডিটক্সের মাধ্যমে মোবাইল ফোন আসক্তি থেকে নিজেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।
শিশুদের বিনোদনের জন্য বিকল্প ক্ষেত্র তৈরি করা এবং শিশুদের মাঠমুখী করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। সামাজিক সংগঠনগুলোর সচেতনামূলক প্রচারণা সৃষ্টি করতে হবে। ভালো মানের যেকোনো বই পড়া, ছবি আঁকা, সিনেমা দেখা, গান শোনা, প্রার্থনা, ব্যায়াম, ঘুরতে যাওয়া এবং বšু¬ ও সমবয়সীদের সঙ্গে মাঠে যাওয়া খেলাধুলা করার ব্যবস্থা করতে হবে। অবশ্যই বই পড়া ও ধর্মকর্মে মনোযোগ এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তবে মনে রাখা ভালো, রাষ্ট্র ও সমাজের তুলনায় পারিবারিক সচেতনতাবোধ এই আসক্তি থেকে বের হতে বেশি সহায়ক। আমরা চাই এমন সুন্দর এক বাংলাদেশ, যা তরুণ কবি মাহবুব রুমনের ভাষায়Ñ‘বিশ্বের অপার বিস্ময়ে মাথা তুলে দাড়ায় এক দেশ/ অজেয়-অপরাজেয় ভূখণ্ড/ আমার প্রাণের বাংলাদেশ।
শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়