মো. মিঠুন: গত কয়েক দশকে পৃথিবীব্যাপী কার্বন নিঃসরণের মাত্রা অধিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সমস্যা ত্বরান্বিত হয়েছে। বিশেষ করে নগর পরিকল্পনায় যান্ত্রিকবাহনকে প্রাধান্য দেয়ায় যানজট, দূষণ, জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে বহুগুণে। কাজেই নগর পরিকল্পনায় পরিবেশবান্ধব যাতায়াত ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিলে আমাদের নগরগুলোকে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হতো।
পরিবেশের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো উন্নয়নই টেকসই হয় না। দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক পন্থায়ই সব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের নির্দেশনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে দ্রুত নগরায়ন ঘটছে যার ছোঁয়া লেগেছে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে। এ ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়ে বাসযোগ্য নগরী এখনও গড়ে ওঠেনি। সেই সঙ্গে নাগরিক চাহিদার প্রতিফলন যথাযথভাবে না থাকায় তাদের জীবনমানেরও উন্নয়ন হয়নি।
নগর সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ কেবল নগরে বা শহরকেন্দ্রিক জীবনের আশায় গ্রাম থেকে শহরমুখী হয়েছে। সবার ধারণা শহরেই কেবল সব নাগরিক সুবিধাদি পাওয়া যায় এ ধারণার কারণেই মূলত দিন দিন আমাদের ঢাকা শহরেও মানুষের তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বর্তমান সময়ে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো উপেক্ষিত হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন অভীস্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এর ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৯, ১০, ১১ অভীস্ট লক্ষ্যে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, অভিঘাতসহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই শিল্পায়নের প্রবর্ধন এবং উদ্ভাবনার, প্রসারণ, অন্তঃ ও আন্তঃদেশীয় অসমতা কমিয়ে আনা, অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, অভিঘাতসহনশীল এবং টেকসই নগর ও জনবসতি গড়ে তোলা বিষয়ের ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে। একটি নগর নিজে থেকে কখনোই নষ্ট ও বসবাসের অনুপযোগী হয় না আমাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবন আচরণ এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন ও ভোগবিলাসের কারণেই নগর বা শহর অবসবাসযোগ্যে পরিণত হয়। ১৪৬৩.৬০ বর্গকিলোমিটার ৫৬৫ বর্গমাইলের আমাদের বর্তমান ঢাকা শহরের অবস্থাও আজ তাই। রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের জনশুমারির হিসাব অনুযায়ী, শহরে ১ কোটি ২ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। এত বিপুল জনসংখ্যার বিপরীত শহরে পার্ক ও খেলার মাঠ ও উদ্যানের সংখ্যা চাহিদার তুলনায় নেই বললেই চলে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জারা কর্ণধার তারা আজ বেশিরভাগ সময়েই পড়াশোনার মাত্রাতিরিক্ত চাপ আর ঘরে বন্দি হয়েই সময় কাটাচ্ছে। আমাদের ঢাকা শহরের ৬০ শতাংশ শিশুই তাদের বিনোদনের উৎস হিসেবে মোবাইল ফোনসেট, কম্পিউটারসহ নানা গেজেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। মানসিক মেধা বিকাশ ও শরীরচর্চা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা হরহামেশাই দেখতে পাই যেখানে সেখানে নগর উন্নয়নের নামে উঁচু উঁচু ইমারত নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানা অনেক স্থানেই নেই শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও পার্ক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যেকোনো শহরের প্রতিটি ব্যক্তির জন্য প্রায় নয় বর্গমিটার খোলা জায়গা প্রয়োজন এবং এই খোলা জায়গা হওয়া উচিত পার্ক বা খেলার মাঠ। ২০০৬ সালে আমাদের বর্তমান সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ঘোষণা দিয়েছিলেন, মাঠ/পার্ক ভরাট করে কোনো রকমের আবাসন, শপিংমল, মার্কেট ইত্যাদি করা যাবে না। সে সময়ে এই ঘোষণা সব মহলে প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু আমরা উদ্বিগ্ন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা অমান্য করে কিছু প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় সাধারণ মানুষের চাহিদার বিপরীতে মাঠ, পার্ক, উদ্যান নিয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকারকে বিভ্রান্তকর পরিস্থিতিতে ফেলছে। উল্লেখ্য, মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উম্মুক্ত স্থান, পার্ক এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ এর পরিপন্থি। মাঠ, পার্ক ও উš§ুক্ত স্থান শিশুদের মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত মফস্বল শহর পর্যন্ত খেলার মাঠগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা শহরে এলাকাভিত্তিক যে পরিমাণ মাঠ, পার্ক ও উম্মুক্ত স্থান রয়েছে তা একটি শহরের অনুপাতে খুবই কম, যা রয়েছে তাও বিভিন্নভাবে ভরাট ও দখল হয়ে যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঢাকা ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়নের অংশ হিসাবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৭টিতে কোনো খেলার মাঠ কিংবা পার্ক নেই, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকিস্বরূপ। আমাদের শহরে অনেক নামে বেনামে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে সেখানে নানা নাগরিক সুবিধার কথা শোনা গেলেও শিশুদের জন্য খেলাধুলা ও বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাদের শহরে অনেক জায়গায় খেলার মাঠ ও পার্ক হাঁটা দূরত্বের পথে না হওয়ার কারণে অনেক অবিভাবক তাদের সন্তানকে দূরবর্তী পার্ক ও খেলার মাঠে নিয়ে যেতে উৎসাহ বোধ করেন না। তা ছাড়া বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকা খুললেই দেখতে পাই খেলার মাঠ দখল হয়ে যাচ্ছে অথবা খেলার মাঠে মাসব্যাপী বিভিন্ন ব্যক্তি বা গাড়ি কোম্পানি মেলার আয়োজন করছে। কিছু দিন আগেই আমরা দেখেছি কলাবাগান তেঁতুল তলা খেলার মাঠ রক্ষার জন্য মা ও ছেলেকে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছে। দেখেছি মিরপুরে প্যারিস রোডে খেলার মাঠ রক্ষায় স্কুল শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতে রাজপথে নামতে বাধ্য হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের ফলেও অনেক পার্ক ও খেলার মাঠ ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হয়েছে শিশুসহ সাধারণ মানুষ। আমাদের শহরে এখনও শতভাগ পার্ক ও খেলার মাঠে কিশোরীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে কোনো পার্ক বা খেলার মাঠ প্রতিবন্ধী, বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের ব্যবহার-উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে না। ড্যাপ কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী নগরের মানুষের জন্য যেসব পার্ক ও খেলার মাঠ চিহ্নিত করা হয়েছে তা দ্রুত সংস্কার ও উম্মুক্তকরণ করতে হবে। প্রতিবন্ধী অপ্রতিবন্ধী প্রতিটি শিশুর জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের খেলাধুলা ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রবেশগম্য খেলার মাঠ ও পার্ক তৈরি করতে হবে। পার্ক ও খেলার মাঠগুলোয় যাওয়ার পূর্ব শর্ত হিসেবে তাদের জন্য নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। পার্ক ও খেলার মাঠের সংলগ্ন সড়কগুলোতে সমতলে এবং অপ্রতিবন্ধী শিশুর পাশাপাশি প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য সুবিধাজনক রাস্তা পারাপারের যথাযথ ব্যবস্থা রাখতে হবে। পার্ক ও খেলার মাঠে সবার ব্যবহার-উপযোগী টয়লেট সুবিধা এবং পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। পাড়া, মহল্লাভিত্তিক উম্মুক্ত গণপরিসর তৈরি করতে হবে। বাস্তব ও পরিকল্পিত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অবৈধ ও দখলদারিত্বের হাত থেকে মুক্ত করে সরকারি খাস জমি খুঁজে বের করে সেখানে গণপরিসর তৈরি করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর, পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলা সম্ভব।
উন্নয়ন কর্মী
mithun.00714@gmail.com