ড্রাগন গাছে অভিনব কৌশলে মিলছে বেশি ফলন

মেহেদী হাসান, রাজশাহী : সূর্যদেব পাটে বসেছে। ঘড়ির কাঁটায় বিকাল ৫টা ছুঁইছুঁই। লালিমা ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। ধোঁয়ার মতো দূরের গাছ ঢেকে যেতে শুরু করেছে কুয়াশায়। এদিকে বাগানে সারি সারি ড্রাগন গাছকে দেয়া হচ্ছে ধোঁয়া। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বৈদ্যুতিক বাল্ব। এ অভিনব কৌশলের মারপ্যাঁচে ড্রাগন গাছকে বোঝানো হচ্ছে ১৮ ঘণ্টায় দিন! অবশ্য এ কৌশলে বেশি ফলন মিলছে বলেই চাষির দাবি। এমনই ঘটনার দেখা মেলে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বিদিরপুর গ্রামের ড্রাগনচাষি হেদায়েতুল ইসলামের (হেলাল) ড্রাগন বাগানে। বৈদ্যুতিক বাতির সাহায্যে গাছের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া চালু রাখছেন তিনি। ফলে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে মোকাবিলা করা হচ্ছে শীতকালীন স্বল্পদৈর্ঘ্যরে দিনকে। আগাম ফুল পেতে ড্রাগন গাছের সঙ্গে এমন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে বলে জানান এ চাষি।

জানা যায়, এ কৌশলে গাছকে ছয় ঘণ্টা দিন বড় দেখানো হচ্ছে। মালুম করতে পারছে না গাছ। বিকাল ৫টার দিকে বাল্ব জ্বালিয়ে দিলে রাত ১০টা পর্যন্ত একটানা আলো পড়ছে গাছের ওপর। বাতির আলোর মাঝেই রাত নেমে এলেও গাছ টের পাচ্ছে না। আবার ভোরের আলো ফোটার আগে ৫টার দিকেই বাল্বগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়। তখন গাছ ভাবে, সূর্য উঠে গেছে। ভোর ৬টার দিকে যখন প্রকৃতই সূর্যের আলো ফোটে তখন বাল্বগুলো বন্ধ করা হয়। এ পদ্ধতি অবলম্বন করে গাছে ফুল এসেছে। এক চালান ড্রাগন বিক্রি করেছেন হেলাল।

চট্টগ্রাম, খুলনা, ঢাকা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে গোদাগাড়ীর উদপুর এলাকার হেলালের বাগানের ড্রাগন। সবুজ ফসল নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘গ্রিন ওয়ার্ল্ড বসন্তপুর’ নামে প্রকল্প। পেশায় সবুজায়নকর্মী হলেও বিদেশি ফলের পরীক্ষামূলক চাষাবাদ শুরু করছেন। গড়ে তুলেছিলেন ১২ বিঘা জমিতে ড্রাগন বাগান। তবে মাত্র ২ বছরের ব্যবধানে তার ফল চাষের জমি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ বিঘাতে!

দুই বছর আগে ২০২১ সালের শুরুতে হেলাল সাড়ে পাঁচ বিঘা জমিতে করেন ড্রাগনের বাগান। সেই জমি থেকে গেল বছর সাড়ে ১৩ মেট্রিক টন ড্রাগন বিক্রি করেছেন। তার বাগানে ড্রাগন ছাড়াও রয়েছে ভিয়েতনামের আতা, ক্যাপসিকাম, অ্যাভোকাডো, গুজরাটি খেজুর, মাল্টা, পার্সিমন ইত্যাদি ফল চাষ করছেন তিনি। নতুনভাবে শুরু করেছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় উচ্চমূল্যের ফসল চাষ।

২০২০ সালে চারটি বাল্ব দিয়ে আলো জ্বালিয়ে আগাম ফলন পাওয়ার পরীক্ষাটা চালিয়েছিলেন তিনি। এসব গাছে ফুল ফুটেছে এক মাস আগে। তাই এবার আরও বড় পরিসরে এই আলোর ব্যবস্থা করেছেন হেলাল। তবে এটিকে পরীক্ষামূলকই বলছেন হেলাল। ৫ ফুট পরপর চারটি বাল্ব ব্যবহার করেন হেলাল। ফুলও এসেছিল আগে। কিন্তু দিনে আবার রোদ বেশি থাকায় নিষিক্ত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে ফুলগুলো। এবার দিনে সূর্যের তাপ কম। তাই পরীক্ষামূলক এ পদ্ধতিতে আগাম ফল পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হেলাল।

জানতে চাইলে ড্রাগনচাষি হেলাল বলেন, সন্ধ্যা নামার পর গাছ তার সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু দিন বড় থাকলে গাছ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া চালু রাখে। গাছ যত বেশি খাদ্য গ্রহণ করে তত বেশি বেড়ে ওঠে। ফুলও ফোটে তাড়াতাড়ি। তাই এই কৌশল।

হেলাল প্রায় ৫ কাঠা জমিতে মোট ২৬০টি বিশেষ এ বাল্ব বসিয়েছেন। ১৫ ওয়াটের এই বাল্বগুলো আনা হয়েছে চীন থেকে। এগুলো কৃষিকাজের জন্যই বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। প্রতিটি বাল্বের দাম পড়েছে ৪৭০ টাকা। ৩ হাজার ৬০০ লাক্স আলো দিতে সক্ষম এই বাল্বগুলো। গত দুই মাস ধরে বাল্বগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। চলবে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। দিন বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাল্বের প্রয়োজনীয়তা কমতে থাকবে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, সূর্যের আলোর সঙ্গে বিকিরিত হয় দেড় লাখেরও বেশি রং। যা গাছেদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। আর এই বাল্বগুলো রং ছড়ায় ৩ হাজার ৬০০ ধরনের। আলোর রং সূর্যের রঙের মতোই। তাই সূর্যের আলোর বিকল্প হিসেবে এসব বাল্ব ব্যবহার করা হচ্ছে। এ আলো গাছকে সজাগ ও বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে পুরোপুরি না হলেও বেশ সহায়ক হবে।

রাজশাহী কলেজ উদ্ভিদবিজ্ঞান বিজ্ঞানের ন্যাচার কনজারভেশন ক্লাবের সভাপতি ফয়সাল আহম্মেদ বলছেন, গাছের জীবন আছে তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। ফলে সূর্যের আলো চলে যাওয়ার পরে গাছ সালোকসংশ্লেষণসহ অন্যান্য কার্যক্রম থামিয়ে দিতে পারে। এতে ঝিমিয়ে পড়বে গাছের বৃদ্ধি। বিলম্বিত হবে ফুল ফোটা। তাই আলো সরবরাহ করা হচ্ছে। যেন গাছ ১৮ ঘণ্টা তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। এতে গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বি^ত হবে। কাক্সিক্ষত সময়ে মিলবে ফুল। তবে শতভাগ সফল হবেন এমনটা নিশ্চিত করে বলতে পারা যাবে না।

ড্রাগনচাষি হেলাল বলেন, আলো জ্বালিয়ে দিনের সমাপ্তিটা আড়াল করা হচ্ছে গাছের কাছে। যাতে করে গাছ তার কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে না নেয়, ঠিকভাবে চালিয়ে যায় সালোকসংশ্লেষণসহ অন্যান্য কার্যক্রম। তাহলে তাড়াতাড়ি ফুল আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আর এক মাস আগেই যদি ফুল ফোটে, ফলও বিক্রি হবে এক মাস আগে। তখন দাম বেশি পাওয়া যাবে ফলের। বেশি মুনাফা করার আশায় এই প্রযুক্তির প্রয়োগ।

কৃষি দপ্তর থেকে জানা যায়, সাধারণত ড্রাগন গাছে ফুল আসে এপ্রিল মাসে। জুন থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে ফল পাওয়া যায়। কিন্তু সেই সময়টা কমিয়ে মার্চেই আগাম ফুল আনার চেষ্টা চলছে আলোর মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়াটা একেবারেই ভুল নয়। আলোর মাধ্যমে গাছকে দিন বড় দেখানোর প্রক্রিয়া অকার্যকরও নয়। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখা রয়েছে। গাছে আলোক সক্রিয়তা রয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, বাল্বগুলো বিশেষভাবে তৈরি। সেগুলো সূর্যের আলোর মতো আলো দেয়। তাই গাছ মনে করে, এখনও রাত হয়নি। তিনি বলেন, এখন দিন ছোট। কিন্তু ড্রাগনের ফুল আসতে লম্বা দিনের প্রয়োজন। এই বাল্বের মাধ্যমে দিনটাকে গাছের কাছে লম্বা করা হয়। বাইরের দেশে এটা প্রচলিত প্রযুক্তি। আমাদের এখানে নতুন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০