এক ধরনের ক্যাকটাস-গোত্রের ফল ড্রাগন। এ ফলের গাছ লতানো ইউফোরবিয়া গোত্রের ক্যাকটাসের মতো। এর কোনো পাতা নেই। এ গাছের ফুল ফোটে রাতে। দেখতে অনেকটা নাইট কুইন ফুলের মতো লম্বাটে, সাদা ও হলুদ। ড্রাগনের ফুলকে রাতের রানি নামে অভিহিত করা হয়। ফলের খোসা নরম। একটি ফলের ওজন ১৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম। এর ওজন এক কেজিও হয়ে থাকে। পাকা ফলের শাঁস বেশ নরম। কালোজিরার মতো ছোট বীজযুক্ত, হালকা মিষ্টি ফল এটি। এর ক্যালরি তুলনামূলক কম। ড্রাগন ফলের উৎপত্তিস্থল মধ্য আমেরিকা। তবে আমাদের দেশের মাটিও ড্রাগন চাষের উপযোগী। দেখে নিন এর চাষাবাদ পদ্ধতি:
মাটি ও জমি নির্বাচন
সব ধরনের মাটিতে ড্রাগন চাষ করা যায়। উৎকৃষ্ট জৈবসমৃদ্ধ বেলে-দোঁআশ মাটি চাষের জন্য উত্তম। তবে পানি জমে নাÑএমন উঁচু জমিতে এর চাষ করা ভালো। রোদ পড়েÑএমন খোলামেলা জায়গায় গাছটি দ্রুত বেড়ে ওঠে। জৈবসার গাছটির বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। হালকা বৃষ্টি ফলটির জন্য ভালো। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ফুল ও ফলের সমস্যা হয়। বাড়িতে বড় টব বা কিংবা ড্রামে এ ফল চাষ করা যায়।
রোপণ পদ্ধতি
ড্রাগন ফলের চারা উৎপাদন খুব সহজ। বীজের মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা যায়। তবে সেসব চারায় ফল ধরতে সময় বেশি লাগে। তাই কাটিংয়ের মাধ্যমে শাখা কলম করে চারা উৎপাদন করাই উত্তম। বয়স্ক ও শক্ত শাখা থেকে দেড় ফুট লম্বা ও তেরছা করে কেটে বালি বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে বসিয়ে দিলে ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তা থেকে শিকড় গজায়। কাটিং রাখার জায়গায় শেড বা ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মাটিতেও রস থাকতে হবে। কাটিং সাধারণত মরে না। কাটিংয়ের গাছে তাড়াতাড়ি ফল ধরে। কাটিং থেকে উৎপাদিত গাছে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে ফল ধরতে শুরু করে।
জমি ভালোভাবে চাষ দিয়ে একটি গাছ থেকে অন্যটির দূরত্ব তিন মিটার এবং সারি থেকে সারির তিন মিটার দূরত্বে গাছ লাগানো উত্তম। কাটিং করা কলম গাছ একটি গর্তে চার থেকে পাঁচটি করে লাগানো যায়। তবে অবস্থাভেদে দূরত্ব কম বা বেশি রাখা যেতে পারে। ক্যাকটাস গোত্রের গাছ বিধায় বছরের যে কোনো সময় লাগানো যায়। তবে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে রোপণ করা উত্তম।
সার ব্যবস্থাপনা
ড্রাগনের চারা রোপণের জন্য ২০ থেকে ৩০ দিন আগে প্রতি গর্তে পরিমাণমতো পচা গোবর, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, টিএসপি ও এমপি ১০০ গ্রামমসহ জিপসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট ১০ গ্রাম করে দিয়ে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে রেখে দিতে হবে। সার দেওয়ার ২০ থেকে ৩০ দিন পর গাছ লাগানো যাবে। প্রতিবছর গাছের জন্য ৪০ কেজি পচা গোবর ঠিক রেখে ইউরিয়া ৫০ গ্রাম, টিএসপি ও এমপি ১০০ গ্রাম এবং জিপসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট ১০ গ্রাম করে প্রয়োগ করতে হবে।
পরিচর্যা
চারা লাগানোর পর খুঁটি দিয়ে গাছ বেঁধে দিতে হবে। গাছের কাণ্ড লতানো প্রকৃতির। তিনটি পদ্ধতিতে গাছগুলোকে সাপোর্ট দিতে হয়।
ভিয়েতনাম: পিলারের চারদিকে কাটিংকৃত কলম চারা লাগিয়ে পিলারের সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে।
ফ্লোরিডা: দু’পাশে দুটি খুঁটি পুঁতে মোটা তারের ওপর জাংলার মতো তৈরি করে গাছ তুলে দিতে হয়।
শ্রীলঙ্কা: খুটি পুঁতে দিয়ে চারা লাগিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিতে হয়। খুঁটির চারদিকে বাঁশের চ্যাগারের ওপর মোটর গাড়ির পুরোনো টায়ার দিয়ে তার ওপর গাছের শাখাগুলোকে বাড়তে দেওয়া হয়। এতে ড্রাগন গাছ দ্রুত বাড়ে।
এক বছর বয়সী একটি গাছ প্রায় ৩০টি শাখা তৈরি করে। চার বছর বয়সী গাছ ১৩০টি শাখা তৈরি করতে পারে। আমাদের দেশে রোপণের ১২ থেকে ১৮ মাস পর ফল ধরতে শুরু করে। ফল তোলা শেষে প্রতিটি গাছের ৪০ থেকে ৫০টি শাখার প্রত্যেকটিতে এক থেকে দুটি প্রশাখা রেখে বাকিগুলো ছেঁটে দিতে হবে। ছেঁটে দেওয়ার পর ছত্রাকনাশক ওষুধ স্প্রে করতে হবে।
জাত
ড্রাগন দুই রকমের টক ও মিষ্টি। মিষ্টি স্বাদের ড্রাগন তিন প্রজাতির। লাল ড্রাগন বা পিটাইয়া, কোস্টারিকা ও হলুদ। লাল ড্রাগনের খোসার রং লাল, শাঁস সাদা। কোস্টারিকার খোসা ও শাঁসের রং লাল। হলুদ ড্রাগনের খোসা হলুদ, শাঁসের রং সাদা।
উত্তর আমেরিকার ঊষর অঞ্চলে পাওয়া যায় টক ড্রাগন। খুব টক বলে মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীরা এর রসকে বিভিন্ন ধরনের শরবত তৈরির কাজে ব্যবহার করে।
আমাদের দেশে ফলটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষের জন্য বাউ ড্রাগন ফল-১ ও বাউ ড্রাগন ফল-২ নির্বাচন করা যেতে পারে। প্রথম জাতটির শাঁস সাদা, দ্বিতীয় জাতটির শাঁস লাল।
সেচ
ড্রাগনের গাছে তেমন সেচ লাগে না। তবে শুষ্ক মৌসুমে মাটি শুকিয়ে গেলে অবশ্যই সেচ দিতে হবে। দুই সারির মাঝে পানি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অবশ্যই নালা রাখতে হবে। এসব নালার মুখ আটকে মাঝেমধ্যে পানি ভরে রেখে দিলে সেখান থেকে গাছের শিকড় পানি পায়। তবে লক্ষ রাখতে হবে জমিনে যেন পানি জমতে না পারে। কেননা অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারে না এই গাছ।
ফলন
৯ থেকে ১২ মাস বয়সের একটি গাছে পাঁচ থেকে ২০টি ফল পাওয়া যায়। পূর্ণবয়স্ক একটি গাছে ২৫ থেকে ১০০টি ফল পাওয়া যায়। হেক্টরপ্রতি ফলন ২০ থেকে ২৫ টন হয়।
বালাই ব্যবস্থাপনা
তেমন কোনো রোগ হয় না। পোকাও আক্রমণ করে না। তবে কখনও কখনও শিকড় পচা, কাণ্ড ও গোড়াপচা রোগে গাছ আক্রান্ত হয়।
রোগ ও প্রতিকার
ড্রাগন গাছে তেমন কোনো রোগ ও পোকার আক্রমণ এখনও লক্ষ্য করা যায়নি। কখনও কখনও শিকড় পচা, কাণ্ড ও গোড়া পচা রোগে গাছটি আক্রান্ত হতে পারে।
মূল পচা
গোড়ায় অতিরিক্ত পানি জমে গেলে মূলে পচন দেখা দেয়। গাছকে টান দিলে মূল ছাড়া উঠে আসে। এ জন্য উঁচু জমিতে চাষ করা উচিত। অর্থাৎ যেখানে গোড়ায় পানি জমে না সে স্থানটি বেছে নিলে মূল পচা থেকে রক্ষা পাবে গাছটি। এ বিষয়টি মাথা রাখা উচিৎ খামারির।
কাণ্ড ও গোড়া পচা রোগ
ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হলে এ রোগটি দেখা দেয়। আক্রান্ত গাছটি প্রথমে হলুদ, পরে কালো রঙ ধারণ করে। ওই অংশে পচন শুরু হয়। পচে যাওয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকে। এ রোগ দমনের জন্য ছত্রাক-নাশক ওষুধ যেমন বেভিস্টিন, রিকোমিল, থিওভিট প্রভৃতির যে কোনো একটি দুই গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে দেওয়া যেতে পারে।
পোকামাকড়
পোকা-মাকড়ও খুব একটা সমস্যায় ফেলে ড্রাগন গাছকে। মাঝে মধ্যে এফিড ও মিলি বাগের আক্রমণ দেখা যায়। গাছের কচি শাখা ও পাতার রস চুষে খায় এ ধরনের পোকা। ফলে আক্রান্ত গাছের কচি শাখা ও ডগার রং ফ্যাকাশে হয়ে যায়। গাছটি দুর্বল হয়ে পড়ে। এ পোকা ডগার ওপর আঠালো রসের মতো মল ত্যাগ করে ফলে শুটিমোল্ড নামক কালো ছত্রাক রোগের সৃষ্টি হয়। এতে গাছের খাদ্য তৈরি ব্যাহত হয়। ফলে ফুল ও ফল ধারণ কমে যায়। এ ধরনের পোকা দমনের জন্য যে কোনো কীটনাশক যেমন সুমিথিয়ন, ডেসিস, ম্যালাথিয়ন প্রভৃতি প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২৫ মি.লি. বা পাঁচ ক্যাপ ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করে মুক্তি পাওয়া যায়।
পুষ্টিমান
পুষ্টিকর ফল ড্রাগন। ফলটি মানবদেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি অনেকাংশে পূরণ করে। আহারযোগ্য প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগনে পাওয়া যায় ৮০-৯০ গ্রাম পানি, ৯-১০ গ্রাম শর্করা, ০.১৫-০.৫ গ্রাম প্রোটিন, ০.৩৩-০.৯০ গ্রাম আঁশ, ৩৫-৫০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি, ০.১০-০.৬ গ্রাম চর্বি, ৬-১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৩-০.৭ মিলিগ্রাম আয়রন, ১৬-৩৫ গ্রাম ফসফরাস ও ভিটামিন বি ৩ ০.২ থেকে ০.৪ মিলিগ্রাম।
পুষ্টিমান
ক্যারোটিনসমৃদ্ধ ফল এটি। তাই চোখের যত্নে ফলটি উপকারী
আঁশ বেশি থাকায় হজমশক্তি বাড়ায় ও শরীরের চর্বি কমায়। কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিকারক হিসেবে কাজ করে
এতে থাকা প্রোটিন শরীরের বিপাকীয় কাজে সহায়তা করে
এর ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত করে। দাঁত সুস্থ রাখে
ফলটির ভিটামিন-বি-১ কার্বোহাইড্রেট বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন করে
এর ভিটামিন বি-৩ রক্তের কোলেস্টেরল কমায় ও ত্বক মসৃণ রাখে
এতে থাকা ভিটামিন সি শরীরের কাটা নিরাময় ও ভাঙা জোড়া লাগাতে সাহায্য করে
ড্রাগন ফলের ভিটামিন বি-২ ক্ষুধা, তৃষ্ণা প্রভৃতি মিটিয়ে থাকে
ফসফরাস বেশি থাকায় দেহের কোষ গঠনে সহায়তা করে
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
তাইওয়ানে ডায়াবেটিসের রোগীরা ভাতের পরিবর্তে এ ফল প্রধান খাদ্য হিসেবে খেয়ে থাকে
ফলটিতে ফাইটো অ্যালবুমিন,
অ্যান্টি-অ্যক্সিডেন্ট থাকে, যা ক্যানসারের কারণ হিসেবে দায়ী ফ্রি রেডিক্যাল তৈরিতে বাধা দেয়
ক্রনিক আন্ত্রিক সমস্যার সমাধান করে
লিভারের জন্য খুবই উপযোগী
গবেষণায় জানা গেছে, এ ফল নিয়মিত খেলে ওজন কমে এবং সুন্দর শরীর তৈরি হয়
মানসিক অবসাদ দূর করে
কৃষি-কৃষ্টি ডেস্ক