ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার তীব্র বিরোধিতা করেন

কাজী সালমা সুলতানা:১৯৪৮ সালের ২ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত সময়টাকে বলা যায় ভাষা আন্দোলনের প্রথম গণঅভ্যুত্থান পর্ব। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ’৪৮-এর ১১ মার্চ প্রথম হরতাল পালিত হয়। ২ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে সম্প্রসারিত করা হয়। সম্প্রসারিত এই সংগ্রাম পরিষদই প্রথম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে পরিচিত হয়। এ সময় ভাষা আন্দোলন তীব্রতর অবস্থায় উপনীত হয় এবং জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে ১১ মার্চ হরতালের দিন গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। এর ফলে তৎকালীন সরকার ভাষা আন্দোলন চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে প্রাথমিকভাবে ভাষা আন্দোলনের বিজয় সূচিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ সভায় ৬ এপ্রিল ১৯৪৮ তারিখে বাংলা ভাষাকে পূর্ববাংলার সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার জন্য আইন পরিষদে প্রস্তাব পেশ করা হয়। এই প্রস্তাব ৮ এপ্রিল গৃহীত হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে আবার জ্বলে ওঠে।  (সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এমএ বার্ণিক)

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে কয়েক বছর ধরে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ দিবসটি ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। অধ্যাপক কামরুদ্দিন আহমেদ তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ঐতিহাসিক ১১ মার্চ। দিকে দিকে চলল নওজওয়ানের কুচকাওয়াজ। সুদূর মফস্বল থেকে ছাত্ররা এলেন তাদের মাতৃভাষার দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে। শত সহস্র কণ্ঠে ধ্বনিত হলো ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ঢাকার খাজা পরিবারের আত্মীয় হামিদুল হক চৌধুরী ও ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) পণ করলেন এই আন্দোলন বন্ধ করার জন্য। ঢাকা শহরবাসীকে ভুল বোঝানো হলো। ভাড়াটিয়া গুণ্ডা লেলিয়ে দেয়া হলো। তারা গোটা ছাত্রসমাজ ও বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে। শহরবাসীর পক্ষ থেকে ঢাকা সেন্ট্রাল ক্লাবস কমিটির সম্পাদক ও কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে কমরুদ্দীন একটি চুক্তিও সম্পাদন করেন। তাতে গুণ্ডামির মাত্রা কমে গেল, কিন্তু সম্পূর্ণ শেষ হলো না। জাগ্রত যুব ও ছাত্রসমাজ এগিয়ে চলল। সেদিনের আন্দোলন ঢাকা থেকে বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চাঁদপুর, জামালপুর, ভৈরব, খুলনা, চট্টগ্রাম, ঢাকার অদূরে মতলব, মেহেরপুর, পাবনাসহ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। প্রতিবাদ মিছিল বের করা হয়েছিল এসব জায়গা থেকে।

রাজশাহীতে সেদিন মিছিল-মিটিংয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন আবুল কাশেম চৌধুরী, একরামুল হক, গোলাম রহমান প্রমুখ ছাত্র নেতা। রাজশাহী বিভাগজুড়ে এই আন্দোলন প্রবল জোয়ার সৃষ্টি করে। রাজশাহীতে এই আন্দোলন চলাকালে মারাত্মকভাবে নির্যাতনের শিকার হন গোলাম তাওয়াব।

বগুড়ায় প্রতিবাদ মিছিলের নেতৃত্ব দেন স্বয়ং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি তখন বগুড়া কলেজের অধ্যক্ষ। তার নেতৃত্বে এই প্রতিবাদসভা পুরো বগুড়া জেলাতেই ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন মিছিল শেষে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তার দীর্ঘ সময়ব্যাপী যুক্তি ও তথ্য নির্ভুল ভাষণ সেদিন জনসাধারণকে বিমোহিত করে। 

এর আগে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদ ‘উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে’এই অভিমত প্রকাশ করলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর প্রতিবাদ জানান। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বিভিন্ন সেমিনার ও সভা-সম্মেলনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি তার ‘আমাদের ভাষা সমস্যা’ (১৩২৫ বঙ্গাব্দ) প্রবন্ধে মাদ্রাসায় বাংলা চর্চার ওপর গুরুত্ব তুলে ধরেন। জাতিসত্তা সম্পর্কে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। তার জোরালো ভূমিকার ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ অনেকটাই প্রশস্ত হয়।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০