সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশের ব্যাংক খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৬৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ ঢাকা অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা পেয়েছেন। আর চট্টগ্রামের অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ঋণ সুবিধা পেয়েছেন মাত্র ১৮ দশমিক ৫১ শতাংশ। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর সুবিধার কারণে দেশের ইস্পাতশিল্প, সিমেন্টশিল্প, জাহাজ প্রক্রিয়াজাতকরণ, জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ বড় শিল্পকারখানা চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। কিন্তু কিছু কিছু ব্যবসায়ীর ব্যর্থতার কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের প্রতি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানে উদাসীনতা দেখা দিয়েছে। ফলে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন না। এ কারণে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা পিছিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শিল্প, বাণিজ্য ও অন্যান্য খাতের দেয়া ঋণের পরিমাণ গত ডিসেম্বরে দাঁড়িয়েছিল ১২ লাখ ১০ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এসব বিতরণকৃত ঋণের সর্বোচ্চ ৬৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ঢাকায়। এরপর চট্টগ্রামে ১৮ দশমিক ৫১ শতাংশ, খুলনায় ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, রাজশাহীতে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ, রংপুরে ২ দশমিক ৪২ শতাংশ, ময়মনসিংহে ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ, সিলেটে ১ দশমিক ২৪ শতাংশ ও বরিশালে ১ দশমিক ১৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিল্প, বাণিজ্য ও ট্রেডিং ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যবসায়ীরা বলেন, ২০১০ সালের পর থেকে চট্টগ্রামের শিপব্রেকিং, আবাসান, শিল্প ও ভোগ্যপণ্যের একাধিক বড় ব্যবসায়ী অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দরপতনের কারণে আস্তে আস্তে খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে থাকেন। এরই মধ্যে বড় কয়েকটি গ্রæপ ব্যাংকে ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়। শুধু ব্যবসায়িক কারণে যে ঋণখেলাপি হয়েছিল, তা নয়, অন্য কারণও আছে। যদিও তাদের রক্ষায় ব্যাংকগুলোর তেমন ভ‚মিকা ছিল না। শুধু ব্যাংকিং সহযোগিতার অভাবে তারা শেষ হয়ে যায়। অথচ ব্যাংক ঠিকই চড়া সুদ নিয়েছে। একটা প্রতিষ্ঠান খারাপ হয়েছে বলে পুরো গ্রæপকে ঋণখেলাপি বানিয়ে দিল। তাদের তো সব ধরনের সক্ষমতা ছিল। বর্তমানে এসব বাণিজ্যিক কিংবা শিল্পগ্রæপগুলোর অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।
এছাড়া চট্টগ্রামে গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দরসহ অবকাঠামোগত সংকট ছিল। এখন গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা কেটে গেছে। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ অনুমোদনের জটিলতার কারণে অনেক সময় বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ঢাকার তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে যান। অনেক ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নীতিনির্ধারকরা বিমাতাসুলভ আচরণ করেছেন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি ও বেঙ্গল কর্মাশিয়াল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ঢাকা অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা দেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণের ৬৮ শতাংশ পেয়েছেন। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা মাত্র ১৮ শতাংশ ঋণ পেয়েছেন। এটা দুঃখজনক। একই সঙ্গে চরম বৈষ্যমমূলক আচরণও। এটা কাম্য নয়। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মানে তো ঋণখেলাপি নন। প্রয়োজনে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করা হোক। তিনি বলেন, সব ব্যবসায়ীর ঋণপ্রাপ্তির অধিকার আছে। অথচ চট্টগ্রাম অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের ঋণের ফাইলের বিষয়ে ঢাকার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। ব্যাংক শাখা অফিসগুলোর ঋণ প্রদানের ক্ষমতা নেই। এ কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী অসমপ্রতিযোগিতার সম্মুখিন হচ্ছে। আর একটি গ্রæপের একটি প্রতিষ্ঠান খারাপ হলে বাকি আরও ১০/১২টি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়ে পুরো গ্রæপকে ঋণখেলাপি বানিয়ে দেবে, এটা তো ঠিক নয়। আর ব্যবসা তো কয়েক বছরের জন্য নয়, একটি গ্রুপ অব কোম্পানির হবে ব্যবসা হবে ৫০ বছর কিংবা আরও বেশি বছরের। সুতরাং মাসে মাসে মুনাফা করার প্রবণতার চিন্তা বাদ দিতে হবে। তাহলে দেশের উন্নয়ন হবে।
নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, দেশের ব্যবসা ও বাণিজ্যের সূচনা চট্টগ্রাম থেকে শুরু হয়েছিল। কিন্তু ২০০৮-১০ সালের দিকে পুরোনো জাহাজ আমদানি ব্যবসা ও ভোগ্যপণ্যের দামের ওঠানামার কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ে বড় ধাক্কা লাগে। এর ফলে ২০১০ সালের পর চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ীই ঋণখেলাপি হয়ে পড়েন। আবার তাদের কেউ কেউ এক ব্যবসায়ের নামে ঋণ নিয়ে তা অন্য খাতে ব্যবহার করেছিলেন। বিশেষ করে জমিতে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করেছিল। এ রকম পরিস্থিতির কারণে চট্টগ্রামে ঋণের বিষয়টি অধিকাংশ ব্যাংক নেতিবাচকভাবে নিত। ফলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের অসমতা সৃষ্টি হয়েছে। আশা করছি, আগামীতে আবারও চট্টগ্রামে ভালো বিনিয়োগ হবে। কারণ চট্টগ্রাম অবস্থানগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। আর দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরসহ বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল, ভারী শিল্প, মেগা প্রকল্পগুলো চট্টগ্রামে অবস্থান। সুতরাং বিনিয়োগের নতুন দ্বার কিন্তু চট্টগ্রাম দিয়ে শুরু হবে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা বিভাগে ব্যাংকঋণের স্থিতি প্রায় আট লাখ ১৭ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। আর চট্টগ্রাম বিভাগে ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ২৪ হাজার ৮৪ কোটি টাকা।