Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 10:51 am

ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ব্যয় ভারতের তিনগুণ!

ইসমাইল আলী: যানজট নিরসনে মেট্রোরেল বিশ্বব্যাপী একটি কার্যকর ব্যবস্থা। পাশের দেশ ভারতে মেট্রোরেল ব্যবস্থা কয়েক দশক আগেই চালু হয়েছে। এছাড়া গত এক দশকে দেশটিতে বেশ কয়েকটি নতুন মেট্রোরেল চালু করা হয়েছে। আর ঢাকায় উত্তরা-মতিঝিল রুটে প্রথম মেট্রোরেল আগামী বছর চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও ভারতের বিভিন্ন শহরের তুলনায় ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ব্যয় দুই থেকে তিনগুণ।

এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভারতের বিভিন্ন শহরে মেট্রোরেল নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় চার থেকে ছয় কোটি ডলার। কিন্তু ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিল রুটে নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের জন্য কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ১২ কোটি ডলারের বেশি। মেট্রোরেল নির্মাণকারী ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) এক বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। যদিও এ ব্যয়কে বেশি বলে মনে করে না ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ।

‘কস্ট অব কনস্ট্রাকটিং মেট্রোরেল ইন ইন্ডিয়া ভার্সেস ঢাকা মেট্রো!’ শীর্ষক বিশ্লেষণটিতে ভারতের ৮টি শহরের সঙ্গে ঢাকার মেট্রোরেল নির্মাণ ব্যয়ের তুলনা করা হয়। এতে বলা হয়েছে, দিল্লি মেট্রোর সঙ্গে ঢাকা মেট্রোর ব্যয়ের কোনো তুলনা হয় না। কারণ দিল্লি মেট্রোর শেষ পর্ব নির্মাণশেষে উদ্বোধন করা হয় ২০১১ সালে। বাকিগুলো আরও আগে নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া দিল্লি মেট্রো মাটির নিচ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। আর উড়ালপথের (এলিভেটেড) চেয়ে ভূ-গর্ভস্থ (আন্ডারগ্রাউন্ড) মেট্রোরেল নির্মাণ ব্যয় তিনগুণ বেশি।

যদিও ভারতের নির্মাণাধীন ও গত কয়েক বছরে নির্মিত মেট্রোরেলগুলোর ব্যয়ের তুলনা বিশ্লেষণটিতে উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে মেট্রোরেল (দ্বিতীয় পর্যায়) নির্মাণ প্রকল্পটি নেয়া হয় ২০১৪ সালে। ৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মেট্রোরেলের ১৩ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড। আর ৬১টি স্টেশনের মধ্যে ১২টি মাটির নিচে। এরপরও মেট্রোরেলটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪৭০ কোটি ডলার। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। মেট্রোরেলটির একটি অংশ ২০১৮ সালে শেষ হয়েছে ও বাকি অংশ ২০২৩ সালে শেষ হবে।

জয়পুরে মেট্রোর প্রথম পর্বের কাজ শুরু করা হয় ২০১০ সালে। ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মেট্রোরেলের দুই দশমিক ৭৮ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড। আর ১১টি স্টেশনের ৩টি মাটির নিচে। মাত্র ৫০ কোটি ডলারে নির্মাণ শেষে ২০১৪তে উদ্বোধন করা হয় মেট্রোরেলটি। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ে ৪ কোটি ১৭ লাখ ডলার। এর দ্বিতীয় পর্বের কাজ শুরু করা হয় ২০১৬ সালে। ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মেট্রোরেলের প্রায় ৬ কিলোমিটার মাটির নিচে। আর ২০টি স্টেশনের ৫টি ভূ-গর্ভস্থ। ১০২ কোটি ডলার ব্যয়ে এটির নির্মাণকাজ শেষে চলতি বছর উদ্বোধনের কথা রয়েছে। এতে কিলোমিটারপ্রতি  ব্যয় হচ্ছে ৪ কোটি ২৫ লাখ ডলার।

চেন্নাই মেট্রোরেল নির্মাণ শুরু করা হয় ২০০৯ সালে। ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মেট্রোর ২৪ কিলোমিটারই আন্ডারগ্রাউন্ড। আর ৩৪টি স্টেশনের ২০টি মাটির নিচে। ২০১৫ সালে আংশিক উদ্বোধনকৃত এ মেট্রোর পুরোটা ২০১৬ সালে চালু করা হয়। বড় অংশই আন্ডারগ্রাউন্ড হলেও এটি নির্মাণে ব্যয় হয় ২৪৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ে ৫ কোটি ৫৫ লাখ ডলার।

হায়দরাবাদ মেট্রোর নির্মাণ শুরু করা হয় ২০১২ সালে। ৭২ কিলোমিটার এ মেট্রোর নির্মাণশেষে ২০১৭ সালে উদ্বোধন করা রয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ২৭৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ৩ দশমিক ৮১ কোটি ডলার। আর নাভি মুম্বাই মেট্রোরেল নির্মাণ শুরু করা হয় ২০১১ সালে। ২০১৮ সালে এটি উদ্বোধন করা হয়েছে। ২৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মেট্রো নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে মাত্র ৬৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হচ্ছে ২ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। এটি ভারতের সবচেয়ে কম ব্যয়ের মেট্রো।

এদিকে ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ লক্ষ্মৌ মেট্রো নির্মাণ শুরু করা হয়েছে ২০১৪ সালে। এর প্রায় ১০ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড। আর ৩৪ স্টেশনের ১০টি মাটির নিচে। ২০১৭ সালে উদ্বোধনকৃত মেট্রোটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২০৫ কোটি ডলার। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ৫ কোটি ৬৯ লাখ ডলার।

আহমেদাবাদ মেট্রোর নির্মাণ শুরু হয়েছে ২০১৫ সালে। ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মেট্রোর ৬ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড। এতে ব্যয় হচ্ছে ১৮২ কোটি ডলার। ফলে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হবে ৫ কোটি ছয় লাখ ডলার। ২০২০ সালে এটি উদ্বোধনের কথা রয়েছে। এছাড়া নাগপুর মেট্রোর নির্মাণও শুরু হয়েছে একই বছর। আগামী বছর এর একটি অংশ উদ্বোধনের কথা রয়েছে। ৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৪০ কোটি ডলার। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়বে ৩ কোটি ৬৮ লাখ ডলার।

এদিকে উত্তরা-মতিঝিল রুটে ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা বা ২৫৯ কোটি ডলার। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে প্রায় ১২ কোটি ৮৯ লাখ ডলার।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ভারতে নির্মিত ও নির্মাণাধীন মেট্রোগুলোর ব্যয় তুলনামূলক অনেক কম। এক্ষেত্রে ঢাকা মেট্রো নির্মাণে ব্যয় অনেক বেশি। এটি বুয়েট পর্যালোচনা করে দেখেছে। তবে ভারত ও বাংলাদেশের মেট্রো নির্মাণের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এছাড়া দেশটি কয়েকটি মেট্রো নির্মাণ করেছে। এজন্য তারা এ খাতে অভিজ্ঞ। আর নিজস্ব অর্থায়নে এসব মেট্রো নির্মাণ করে ভারত। ফলে ব্যয়ের ক্ষেত্রে অনেক যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ থাকে।

এদিকে ঢাকা মেট্রো নির্মাণে অত্যধিক ব্যয়ের ব্যাখ্যাও রয়েছে ডিএমটিসির বিশ্লেষণে। এতে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির ব্যয় অনেক বেশি; কারণ ভারতের বিভিন্ন শহরের মেট্রোর স্টেশনগুলো আকারে ছোট। তবে ঢাকার মেট্রোতে চলাচল করবে তুলনামূলক বড় আকারের ট্রেন। এতে যাত্রী ওঠানামা বেশি হবে। এজন্য স্টেশনগুলোর আকারও বড় হবে। এছাড়া ভারতে মেট্রো নির্মাণে বড় ধরনের কর অব্যাহতি রয়েছে। তবে ঢাকায় মেট্রো নির্মাণে সরকার নির্ধারিত সব ধরনের কর ও ভ্যাট দিতে হবে। এছাড়া মেট্রোর বিদ্যুৎ সঞ্চালনও একটি বড় ফ্যাক্টর। ভারতে সাবস্টেশন ও সঞ্চালন লাইন নির্মাণ ব্যয় অনেক কম। এছাড়া বাংলাদেশে মেট্রোর পরামর্শক ব্যয় অনেক বেশি। আর বাংলাদেশকে ট্রেন আমদানি করতে হবে। তবে ভারত নিজ দেশের তৈরি ট্রেন ব্যবহার করছে। এসব কারণে মেট্রো রেলের ব্যয় বেশি হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা ঋণ দেবে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। বাকি অর্থ সরকারের তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে। মেট্রোরেল প্রকল্পটি ২০১২’র ডিসেম্বরে অনুমোদন হলেও এখন পর্যন্ত ৬০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নির্মাণশেষে আগামী বছর ডিসেম্বরে মেট্রোরেলটি উদ্বোধনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।