মাসুম বিল্লাহ: কূটনৈতিক দিক দিয়ে সময়টা ভারতের জন্য অনুকূল নয়। গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চীনের সঙ্গে চলছে একপ্রকার যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। বিষয়টি রূপ নিয়েছে ঠাণ্ডা লড়াইয়ে। কূটনৈতিক ব্যর্থতার জন্য নিজ দেশেই ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি প্রশাসন। এমন সময় প্রতিবেশী দেশসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নিচ্ছে ভারত। এ ডামাডোলের মধ্যেই বদল হতে যাচ্ছেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার। এরই মধ্যে ভারতীয় গণমাধ্যমে পরবর্তী হাইকমিশনারের নাম এসেছে। তবে এখনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি।
রীভা গাঙ্গুলী দাশকে যদি এ মুহূর্তে প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে তিনি হবেন ঢাকায় সবচেয়ে কম সময় দায়িত্বপালনকারী ভারতীয় শীর্ষ কূটনীতিক। ২০১৯ সালের মার্চে তিনি ঢাকায় হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সে হিসাবে তার দায়িত্বকাল এক বছর চার মাসেরও কম। এরই মধ্যে তাকে প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে দিল্লি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রীভা গাঙ্গুলীর আগ পর্যন্ত ১৫ জন ভারতীয় হাইকমিশনার ঢাকায় দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা কেউই এত কম সময় দায়িত্বে ছিলেন না।
যে কোনো দেশের ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিবেচনায় প্রতিবেশী দেশে সবসময় অভিজ্ঞ কূটনীতিকদের নিয়োগ দেওয়ার নজির রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশই নিজ নিজ হাইকমিশনে সবসময় অভিজ্ঞ কূটনীতিকদের নিয়োগ দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম হাইকমিশনার হিসেবে ঢাকায় নিযুক্ত হয়ে এসেছিলেন সুবিমল দত্ত। তিনি ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক। তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে ভারত সরকার তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছিল। তিনি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭৪ সালের জুন পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। এ কূটনীতিকের পূর্ব পুরুষ ছিলেন চট্টগ্রামের অধিবাসী। এরপর দ্বিতীয় হাইকমিশনার এস সেন দায়িত্বে ছিলেন ১৯৭৪ সালের জুলাই থেকে ১৯৭৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত।
ভারতীয় কূটনীতিকদের মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছেন দেব মুখার্জি। তিনি ১৯৯৫ সালের মার্চ থেকে ২০০০ সালের জুলাই পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। এরপর আসেন এমএল ত্রিপাঠী। তিনি ছিলেন ২০০০ সালের জুলাই থেকে ২০০৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। এরপর পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করেছেন বীণা সিকরি, নিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী, রাজিত মিত্র, পঙ্কজ সরণ ও হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। আর এস সেনের পর পর্যায়ক্রমে হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন কেপিএস মেনন, মুচকুন্দ দুবে, আইপি খোসলা, আইএস চাড্ডা, কে শ্রীনিবাসন ও কে রঘুনাথ। এই ১৫ জনের কেউই রীভা গাঙ্গুলীর মতো এত কম সময় দায়িত্ব পালন করেননি।
চীনের সঙ্গে বিবাদ শুরুর পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনীতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারের উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। এমনকি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মুখ খুলেছে দেশটি। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বিষয়টি উল্লেখও করেছেন। যদিও গত তিন বছরে প্রত্যাবাসন বিষয়ে দিল্লিকে পাশে পায়নি ঢাকা। কিন্তু এ সম্পর্কোন্নয়নে রীভা গাঙ্গুলীর ওপর দিল্লি ভরসা করতে পারছে না বলে গুঞ্জন রয়েছে। তাছাড়া কিছুদিন আগে বাংলাদেশকে বেশকিছু অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যিক সুবিধার ঘোষণা দিয়েছে চীন। মহামারি করোনা মোকাবিলায়ও বাংলাদেশকে সহায়তা দিয়েছে চীন। এমনকি চীনের আবিষ্কৃত টিকাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলেও দেশটি জানিয়েছে। এসব বিষয়কে বাংলাদেশকে পাশে টানার কৌশল হিসেবে দেখছে ভারত। দেশটির গণমাধ্যমগুলো এমন খবর প্রচার করেছে। আর বাংলাদেশও চীনের দিকে হেলে পড়ছে বলে ধারণা দেশটির বিশ্লেষকদের। এর পরপরই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের ঘোষণা আসে ভারতের তরফ থেকে। আর সেই ডামাডোলের মধ্যেই গতকাল হিন্দুস্তান টাইমসে খবর বের হলো, নয়াদিল্লির ‘অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র’ ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে বিক্রম দোরাইস্বামীকে। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ঢাকায় হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করে আসা রীভা গাঙ্গুলী দাশের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন বিক্রম দোরাইস্বামী।
এত অল্প সময়ের ব্যবধানে হাইকমিশনার বদলের কারণ কী হতে পারেÑসে বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, নানা কারণেই একজন কূটনীতিক বদল হতে পারে। আর এটি ভারতের নিজস্ব ব্যাপার। তাছাড়া অনুমানের ভিত্তিতে কোনো মন্তব্য করাও উচিত নয়। তবে এটা ধারণা করা যায়, যে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে মৈত্রী আরও বেশি সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে যাকে উপযুক্ত মনে করছে, তেমন একজন কূটনীতিককে হয়তো নিয়োগ দেবে।
ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বিক্রম দোরাইস্বামীকে ঢাকায় নতুন হাইকমিশনার নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আর রীভা গাঙ্গুলী ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছন বলে আভাস দিয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস। ১৯৯২ ব্যাচের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বিক্রম দোরাইস্বামী অতিরিক্ত সচিব হিসেবে আন্তর্জাতিক সংগঠন ও সম্মেলন বিভাগের ইনচার্জ। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে পড়েছেন তিনি। এর আগে দক্ষিণ কোরিয়া ও উজবেকিস্তানে ভারতের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বও সামলেছেন এই পেশাদার কূটনীতিক। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব থাকার সময়ে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার বিভাগে নানা দায়িত্ব পালন করেছেন। মন্ত্রণালয়ের সার্ক বিভাগের প্রধানের দায়িত্বও একসময় তার কাঁধে ছিল।