Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 12:40 am

ঢাকার আদি বসতি

ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা।    পর্ব-৯

 

মিজানুর রহমান শেলী: এই ঢাকায় প্রাচীন আমল থেকেই ইট-পাথরের দালানকোঠার চল শুরু হয়েছে। কিন্তু সেসব দালানকোঠার বেশিরভাগই ছিল রাজ-রাজরাদের সিংসহাসন, আবাসস্থল ও দুর্গ। তবে সাধারণেরও সংযোগ ছিল ইটনির্মিত উপাসনালয়ে। মন্দির, মসজিদ কিংবা চার্চ। তবে আবাসন হিসেবে প্রাচীন আমলে সাধারণের হাতে গড়া তেমন কোনো পাকা বাড়ির নিদর্শন পাওয়া যায় না। মোগল আমলে কিংবা ব্রিটিশ আমলজুড়ে অবশ্য কিছু বণিক ব্যবসায়ী এখানে পাকা ইটের ঘর করেছিল।

প্রাক-মোগল আমলের ঢাকার পাশের বিক্রমপুর ও তের শতকের শেষার্ধে ঢাকার আরেক পাশের সোনারগাঁও বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ফলে সে সময় ওই অঞ্চলের আবাসন ও অন্যান্য স্থাপত্য এবং স্থাপত্যশিল্পের উন্নয়ন হয়। প্রাক-মোগল আমলের দুটি মসজিদের লিপি থেকে ঢাকার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তাতে বোঝা যায় তখন এই ঢাকা বাহারিস্তান-ই-গায়েবি থেকেও কম গুরুত্বের ছিল। বুড়িগঙ্গার উত্তর তীরে বাবুবাজারের পূর্বে, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব অংশ নিয়েই গড়ে ওঠে প্রাক-মোগল ঢাকা। মানচিত্র-১ এ সময় এ অঞ্চলগুলো বিভিন্ন হিন্দু নামে গড়ে ওঠে। যেমনÑলক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, জালুয়ানগর, বানিয়ানগর, গোয়ালনগর, তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, ছুতারনগর, কামারনগর, পাটুয়াটুলী, কুমারটুলী ইত্যাদি। বুড়িগঙ্গা ও দোলাই নদীর তীরঘেঁষে এই শহর তাই সোনারগাঁওয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে চলেছিল। নসওয়ালগলি মসজিদ (১৪৫৯ খ্রি.) ও ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রাক-মোগল বয়সকে হিসাবে এনে বিচার করলে বোঝা যায় ঢাকা শহর তখন বাবুবাজার ছাড়িয়েও ঢাকেশ্বরী-উর্দু রোড অবধি বিস্তৃত ছিল। মিরপুরের শাহ আলী বাগদাদির দরগাহর অস্তিত্ব (আ. ১৫৫৭ খ্রি.) ঢাকার এ অঞ্চলে প্রাক-মোগলের বসতির প্রমাণ রাখে। সম্ভবত এটাই বলা চলে, বুড়িগঙ্গার প্রবাহ বরাবর নগরের দক্ষিণ, পশ্চিম এবং উত্তর-পশ্চিম অংশে বসতি গড়ে উঠেছিল। নগরীর পশ্চিম বসতিগুলো রায়েরবাজারের নদীতীরের কুমারপাড়া হিসেবে গড়ে উঠেছিল। এসব বসতিগুলোর আসল বয়স ধারণা করা যায় না। এমনকি এগুলো ছিল অনেকটা বিক্ষিপ্ত। তবে বাবুবাজারের বসতি ছিল ঘন।

প্রাক-মোগল ঢাকা আকবরের সামরিক অভিযানের সময় একটি সামরিক ঘাঁটি বা থানায় রূপান্তরিত হয়। ইসলাম খানের হাত ধরে এর প্রসিদ্ধি লাভ করতে থাকে জাহাঙ্গীরনগর নামে। বাহারিস্তান থেকে বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগারের কাছে তার দুর্গ ও চাঁদনীঘাটের কথা জানা যায়। দুর্গ আর চাঁদনীঘাটের মাঝে বাদশাহি বাজার (চকবাজার) ও দুর্গের পশ্চিমে উর্দুবাজার হয়তো সমসময়ে গড়ে ওঠে। তিনি বাবুবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা থেকে মালিটোলা-তাঁতীবাজারের কাছে দোলাইখাল পর্যন্ত একটি খাল খনন করা হয়। এটা ইসলাম খানের নতুন ঢাকার সীমানা নির্মাণ করেছিল। মানচিত্র-২। বাবুবাজার থেকে পাটুয়াটুলী পর্যন্ত এলাকাটি ইসলামপুর নামে পরিচিত ছিল। বংশাল-মালিবাগ এলাকার পুরোনো মোগলটুলীর অস্তিত্ব পুরান ঢাকায় মোগলদের প্রথম দখলদারিত্বের প্রমাণ মেলে। এরপর ১০০ বছরের মধ্যে এই ঢাকা একটি ছোট নগর বসতি থেকে মহানগরে পরিণত হয়। এ সময় পর্যন্ত ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা উপভোগ করে। মোগলরা এই নতুন ঢাকা আর পুরান ঢাকা এক করে নিয়ে পুরো ঢাকাকে নিজেদের মতে করে সাজিয়ে নিয়েছিলেন। ফলে তা পূর্বে নারিন্দা, পশ্চিমে মানেশ্বর, হাজারীবাগ এবং উত্তরে রমনার শেষ প্রান্ত ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। মোগলরা পশ্চিম সীমান্তে গড়ে তোলে পিলখানা। পশ্চিমে দুর্গ ও পিলখানার মধ্যবর্তী স্থান এবং উত্তরে দুর্গ ও ফুলবাড়িয়ার মধ্যবর্তী স্থানে রাজকীয় কর্মকর্তা, সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী প্রভৃতিদের আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে।

তবে এই আবাসিক এলাকাটিকে একালের চোখে দেখলে খুব বেশি পরিকল্পিত বলা চলে না। হয়তো অস্থায়ী আবাসনই তারা গড়ে তুলত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য। কেননা সুবাদারসহ স্টাফদের নিয়মিত বদলি হতে হতো। সেখানকার রাস্তাগুলো ছিল অনেকটা কুণ্ডলি পাকানো প্রকৃতির। এটা হয়তো কোনো নিরাপত্তা কৌশল বা বিশেষ সুবিধাকল্পে সৃষ্টি করা হয়েছিল। যেটা আজ পুরান ঢাকা নামে পরিচিত। আজও এই পুরান ঢাকা নগরটি সুস্পষ্টভাবেই মোগল শহরের ছাপ বহন করে।

দুর্গটি ছিল শহরের প্রধান কেন্দ্রে। শহরের অন্যান্য এলাকা আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে গড়ে উঠেছিল। দুর্গের দক্ষিণ এবং একেবারে নদী পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ গড়ে উঠেছিল বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে। উত্তর-পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ছিল পুরোপুরি আবাসিক। নগরের উত্তর সীমানা মীরজুমলার (১৬৬০-১৬৬৩) নির্মিত প্রধান ফটক পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। এ তোরণটি তিন নেতার মাজারের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গ্রন্থাগারের পূর্বে অবস্থিত। মীরজুমলা রাজধানী প্রতিরক্ষার জন্য দুটি রাস্তা তৈরি করেছিলেন। এটি দূরবর্তী দুর্গের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত। একটি রাস্তা ছিল উত্তরে টঙ্গী-জামালপুর দুর্গ এবং অপরটি পূর্বে ফতুল্লা দুর্গ পর্যন্ত।

তবে শহরের আবাসন, স্থাপত্য, অবকাঠামো ব্যাপকভাবে নির্মিত হয়েছিল শায়েস্তা খানের আমলে (১৬৬৩-১৬৭৮; ১৬৭৯-১৬৮৮)। সে সঙ্গে ঢাকা শহরও বেড়েছিল ব্যাপক হারে। তাই ১৬৬৬ সালে ঢাকা ভ্রমণকারী জে.বি টেভার্নিয়ারের মতে, ঢাকা ছিল এক বিশাল শহর। তার মতে, ঢাকা বৃদ্ধি পায় শুধু লম্বায়। কেননা সবাই নদীর তীরে বাস করতে চাইত। টমাস বাউরি এসেছিল ১৬৬৯-১৬৭৯ সময়ের মধ্যে। তার বর্ণনায় ঢাকার পরিধি ছিল প্রায় ৪০ মাইল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম দিকের দলিল অনুযায়ী (১৭৮৬ ও ১৮০০) শহরের সীমানা ছিলÑদক্ষিণে বুুডিগঙ্গা, উত্তরে টঙ্গী, পশ্চিমে জাফরাবাদ, মিরপুর এবং পূর্বে পোস্তগোলা পর্যন্ত।

উল্লেখ্য, মীরজুমলার ঢাকা তোরণের উত্তরে লোকবসতি ছিল বিক্ষিপ্ত। ইউরোপীয় বাণিজ্য কোম্পানিগুলোর মিল-ফ্যাক্টরি ছিল তেজগাঁও এলাকা ঘিরে। ফুলবাড়িয়া এবং ঢাকা তোরণের মধ্যবর্তী এলাকাটি বাগ-ই-বাদশাহি নামে পরিচিত ছিল। এটা মূল মোগল শহরের বাইরে একটি বহিস্থবলয় নির্মাণ করেছিল। মোগল শহরের বিস্তার হয়েছিল মূলত দুর্গের পশ্চিম দিকে। আর বসতি বেড়েছিল নদীতীর বরাবর শহরের উত্তর-পশ্চিম দিকে জাফরাবাদ-মিরপুর এলাকা পর্যন্ত।

শায়েস্তা খানের সাত গম্বুজ মসজিদ পর্যন্ত বিস্তৃত বর্তমান সাতমসজিদ সড়কটিও শায়েস্তা খানের হাতে নির্মিত। সম্ভবত উত্তর-পশ্চিম দিকে মোগল বসতি গড়ে তুলতে এই রাস্তার প্রয়োজন ছিল। মীরজুমলার বাগ-ই-বাদশাহি ও টঙ্গী সামরিক ঘাঁটির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনকারী সড়কটি ময়মনসিংহের দিকে শহরকে বাড়ন্ত করেছিল এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের দ্বার উšে§াচন করেছিল।

পূর্বে পোস্তগোলা থেকে পশ্চিমে হাজারীবাগ পর্যন্ত এক ফালি উঁচু ভূমি ছিল এই ঢাকায়। এটা উত্তর মোগলদের বাগ-ই-বাদশাহি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উত্তর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলটি পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিক থেকে খাল, জলাশয় ও নিচু জলাভূমি দ্বারা বিচ্ছিন্ন ছিল।

ধানমন্ডি, শ্যামলী-কল্যাণপুর এবং মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ছিল নিচু জলাভূমি। পূর্বে কারওয়ান বাজারের দক্ষিণে উঁচু ভূমির মাঝে বেগুনবাড়ি খাল ছিল আরেক নিচু ভূমি। এ নিচু ভূমি উত্তরে গুলশান, বনানীর উঁচু ভূমি পর্যন্ত এগিয়েছিল। গুলশান-বনানীর উঁচু ভূমিখানি উত্তরা ও টঙ্গী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ এলাকাটি সবদিক ছিল নিচু ভূমি ও জলাশয়। পশ্চিমে তুরাগ এবং পূর্বে বালু নদী দ্বারা প্লাবিত হতো। এই প্রাকৃতিক পরিসর মোগল নগরের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করেছিল। ধানমন্ডি, নিউমার্কেট এলাকা ছিল ধানিজমি। তবে এই ঢাকার ছিল বাণিজ্যিক আভিজাত্য।

পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি এবং আর্মেনীয়রা তাই সতেরো শতকে তেজগাঁও এলাকাতে তাদের ফ্যাক্টরি গড়ে তোলে। ফলে তেজগাঁও এলাকা পরবর্তী শতক এবং এখনও বাণিজ্যিক এলাকার গুরুত্ব পেয়েছে। কারওয়ান বাজারের উত্তরটা ছিল মোগল আমলের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। কারওয়ান বাজারের খাজা আম্বর ব্রিজের পাশে মীরজুমলা নির্মিত সড়কের দুই পাশে ইউরোপীয় বসতি গড়ে ওঠেছিল।

 

লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ।