ইসমাইল আলী: ঢাকার যানজট হ্রাসে বিমানবন্দর এলাকা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ছয় লেনবিশিষ্ট এক্সপ্রেসওয়েটির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ একটি লিংকওয়ে নির্মাণ করা হবে হোটেল সোনারগাঁও থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) পর্যন্ত। তবে পুরো এক্সপ্রেসওয়েটির সঙ্গে ঢাকায় চলমান ও প্রস্তাবিত অন্যান্য প্রকল্পের সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নেই জটিলতা দেখা দিয়েছে।
বিষয়গুলো সমাধানে সম্প্রতি ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) কার্যালয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে জানানো হয়, এক্সপ্রেসওয়ের জন্য নির্মাণাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), নির্মিতব্য ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) বা মেট্রোরেল, ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন রেলপথ, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩-এর সাংঘর্ষিক অবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি এক্সপ্রেসওয়ের পিলারের কারণে হাতিরঝিলের পানি প্রবাহ ও পান্থকুঞ্জের পার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বৈঠকে জানানো হয়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সোনারগাঁও-বুয়েট লিংক অংশটি সোনারগাঁও হোটেল সংলগ্ন হাতিরঝিলের উত্তর পাশ দিয়ে পান্থকুঞ্জ পার্কের ভেতর দিয়ে হাতিরপুল, কাঁটাবন হয়ে পলাশী পর্যন্ত নির্মাণের কথা রয়েছে। এতে ৫৪টি পিলার হাতিরঝিলের পানির মধ্যে পড়বে। এছাড়া পান্থকুঞ্জ পার্কের ভেতরেও কয়েকটি পিলার পড়বে। এতে হাতিরঝিলের পানি প্রবাহ ও পান্থকুঞ্জের সৌন্দর্য বিনষ্ট হবে। বিষয়টি বিবেচনায় ২০১৭ সালের ১ জুন এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাতিরঝিলের ওপর দিয়ে র্যাম্প না নেওয়ার নির্দেশ দেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে হাতিরঝিলের সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রেখে ও যথাসম্ভব পানিতে পিলার পরিহার করে সোনারগাঁও-বুয়েট লিংক অংশের নকশা পুনর্নির্মাণে অনুরোধ করা হয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে। এতে নতুন করে নকশা করা হয়েছে লিংক অংশটির।
বৈঠকে আরও বলা হয়, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাকলি ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সড়কের মিডিয়ানে ১৩টি পিলার নির্মাণ করা হবে। এগুলোর ওরিয়েন্টেশন মিডিয়ান বরাবর না করে কোনাকুনি করা হয়েছে। এতে বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে জটিলতা হবে। আর বিআরটি রাস্তার মাঝখানে দুই লেন বরাবর হবে। বাকি লেনগুলো দিয়ে সাধারণ যানবাহন চলাচল করবে। তাই ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলারের জন্য বিআরটি লেন সরিয়ে নিতে হবে। এতে সাধারণ যানবাহন চলাচলের লেন সংকুচিত হবে।
যদিও জটিলতা এড়াতে বিআরটি’র সঙ্গে সাংঘর্ষিক স্থানে জমি অধিগ্রহণ করে রাস্তা প্রশস্ত করার আশ্বাস দেওয়া হয় বৈঠকে। এছাড়া এয়ারপোর্ট টার্মিনাল-৩ প্রকল্পের নকশার সঙ্গে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সমন্বয় করা প্রয়োজন বলেও বৈঠকে পরামর্শ দেওয়া হয়।
এদিকে প্রস্তাবিত এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে এমআরটি-৫-এর পশ্চিমাংশের সাংঘর্ষিক অবস্থা রয়েছে। মেট্রোরেলের এ অংশটি গাবতলী থেকে টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজ গেট, আসাদ গেট, রাসেল স্কয়ার, পান্থপথ, সোনারগাঁও, হাতিরঝিল, নিকেতন, রামপুরা, আফতাবনগর পশ্চিম, আফতাবনগর কেন্দ্র, আফতাবনগর পূর্ব হয়ে দাশেরকান্দি পর্যন্ত যাবে। উড়ালপথ ও মাটির নিচ (টানেল) মিলিয়ে এ অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭ কিলোমিটার। এ রুটে ১৭টি স্টেশন থাকবে।
বৈঠকে জানানো হয়, এফডিসি গেটের সামনে মগবাজার ফ্লাইওভারের একটি পিলার আছে। তার পাশেই এক্সপ্রেসওয়ের পাঁচটি পিলার নির্মাণ করা হবে। এ পিলারগুলো থাকলে এমআরটি-৫-এর দক্ষিণাংশের টানেল মাটির ৪০ মিটার নিচ দিয়ে নির্মাণ করতে হবে, যা খুবই ব্যয়বহুল। এছাড়া এক্সপ্রেসওয়ের পিলারগুলোর কারণে হাতিরঝিল স্টেশন নির্মাণ করাও দুরূহ হয়ে পড়বে।
যদিও মগবাজার ফ্লাইওভারের জন্য এক্সপ্রেসওয়ের পিলারের প্রস্থ ৪০ মিটার নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়ে বৈঠকে বলা হয়, টেকনিক্যালি এর প্রস্থ আর পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। মেট্রোরেলের সমস্যা সমাধানে এখন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে।
এদিকে হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী নামক জায়গায় মিলিত হবে। এক্ষেত্রে হানিফ ফ্লাইওভারের টাচ ডাউন পয়েন্ট ও এক্সপ্রেসওয়ের টাচ ডাউন পয়েন্ট কাছাকাছি। এতে হানিফ ফ্লাইওভারের টোল আদায় কমে যাওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে।
এর বাইরে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন রেলপথসহ আরও প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তাই রেলের সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ের সমন্বয় করা প্রয়োজন বলেও বৈঠকে জানানো হয়। এছাড়া কমলাপুর আইসিডির সঙ্গেও এক্সপ্রেসওয়ের অ্যালাইনমেন্ট সমন্বয় করতে হবে।
বৈঠকে ডা. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি বেসরকারি বিনিয়োগ প্রকল্প। যদি কোনো কারণে এর নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি পায়, তাহলে বিনিয়োগকারীকে আরও ব্যাংক ঋণ নিতে হবে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হবে। এমনিতেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর বেসরকারি বিনিয়োগ প্রকল্প হওয়ায় বারবার এর ডিজাইন পরিবর্তন ও ব্যয় বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, যানজট নিরসনে গণপরিবহনই সর্বোত্তম সমাধান। ফ্লাইওভার বা এক্সপ্রেসওয়ে সাময়িক সমাধান, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রয়োজনে ভাঙতে হয়েছে। তবে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ অনেক আগে শুরু হয়েছে। বেশ কিছুটা নির্মাণকাজ এগিয়েও গেছে। তাই চলমান অন্যান্য প্রকল্পকে এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সমন্বয় করা উচিত।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ শুরুর কথা ছিল। তবে নকশা জটিলতায় কয়েক দফা পেছানোর পর ২০১৬ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। এর মধ্যে এক দফা বাড়ানো হয়েছে প্রকল্প ব্যয়। তবে নানা জটিলতায় এখনও প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাক্সিক্ষত গতি আসেনি।
ঢাকার যানজট কমানোর মেগা প্রকল্প নিয়ে জট
