Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 3:56 am

ঢাকায় কর্মসংস্থান

ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা। পর্ব-২১

মিজানুর রহমান শেলী: ইংরেজ আমলে বাংলাদেশের মুসলিমরা ছিল গোটা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে অনুন্নত। ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯০৫ লর্ড কার্জন নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর ঢাকার বাসভবন ‘আহসান মঞ্জিল’-এ উপস্থিত শ্রোতাদের সামনে এক বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, ঢাকা এতদিন ছায়া হয়ে পড়ে ছিল। সরকার এখন থেকে ঢাকাকে পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত করবে। এখানে বিনিয়োগ হবে। ফলে মুসলিমরা উপকৃত হবেন ও প্রভূত সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করবেন। এই নতুন প্রদেশের রাজধানী হবে আত্মনির্ভরশীল প্রশাসনিক রীতিনীতির ওপর; যার মূল ভিত্তি হবে এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সংস্কৃতি ও মতামত। ফলে এখানকার মুসলিম জাতি-সংস্কৃতি হিন্দুদের ওপর প্রাধান্য পাবে।
কার্জনের এই মন্তব্য ছিল বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে। বঙ্গভঙ্গ পূর্ববাংলা বা আজকের বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যকে নাড়া দিয়েছিল। এই নতুন প্রশাসনিক কাঠামো কার্যত এ অঞ্চলের মুসলিম জনসাধারণের আর্থিক-সামাজিক কাঠামোকে বহুদিনের অচলাবস্থা বা বঞ্চিতদশা থেকে এগিয়ে নিতে চেয়েছিল। মুসলিমরা লাভবান হচ্ছিল। যেখানে হিন্দুদের কর্তাগিরি মনোভাব খর্ব হচ্ছিল। ফলে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে প্রবলভাবে হামলে পড়ে। ফলে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তাতে এই অঞ্চলের আর্থিক কাঠামো অনুধাবন করা যায়। কার্যত এর প্রেক্ষাপট বড়ই ভারসাম্যহীন।
চাকরি-বাকরির ভারসাম্যের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম স্বার্থ তখন সামনে আসে। কেননা ১৯০১ সালে তৎকালীন বাংলা সরকারের অধীনে উচ্চ পর্যায়ের নিয়োগ হয়। এই নিয়োগে মুসলিমরা মাত্র ৪১টি পদ পেয়েছিল। অন্যদিকে মুসলিম জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ হয়েও হিন্দুরা নিয়োগ পেয়েছিল এক হাজার ২৩৫টি উচ্চপদ। মন্ত্রণালয়, বিভাগ, জেলা এবং সাবডিভিশনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে মুসলিমরা ছিল মাত্র ছয় ভাগের এক ভাগ। পুলিশ বিভাগে মুসলমানদের উপস্থিতি আরও খারাপ। তখন ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল রেঞ্জ’ নামে পরিচিত পুলিশ বিভাগে মোট ৫৪ জন ইন্সপেক্টরের মধ্যে চারজন, ৪৮৪ সাব-ইন্সপেক্টরের মধ্যে ৬০ জন, ৪৫০ হেড কনস্টেবলের মধ্যে ৪৫ জন এবং চার হাজার ৫৯৪ কনস্টেবলের মধ্যে মাত্র এক হাজার ২৭ জন কনস্টেবল ছিলেন মুসলিম। তাছাড়া গ্রামের পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে আদালতের সামনে হাজির হওয়া ব্যারিস্টার পর্যন্ত, সব স্তরে হিন্দুদের প্রভাব ছিল। প্রভাব ছিল শিক্ষাব্যবস্থায়ও। গ্রামের স্কুলশিক্ষক থেকে শুরু করে সচিবালয় পর্র্যন্ত হিন্দু ইতিহাস, রূপকথা ও মূল্যবোধকে পাঠ্যবইয়ে গুরুত্ব দেওয়া হতো। ভূমি ব্যবস্থাপনায়ও গ্রামে জমিদারের কাচারি থেকে জেলার ভূমি রেকর্ড অফিস পর্যন্ত ছিল হিন্দুদের প্রভাব।
এসব কারণে মুসলিম শিক্ষিতগোষ্ঠী বঙ্গভঙ্গের পক্ষে সন্তুষ্ট মনোভাব প্রকাশ করেছিল। কিন্তু বাংলার উচ্চবর্ণের হিন্দু যারা ছিলেন জমিদার, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী এবং বুদ্ধিজীবী তারা ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এর কারণ অনুসন্ধান করেছেন জন আর ম্যাকলেইন। তিনি লিখেছেন, ‘অনেক শিক্ষিত হিন্দু যৌক্তিক কারণেই মনে করতেন যে, বিভক্তির মানে হচ্ছে তাদের প্রাপ্ত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়া’। ‘অনেক বর্ণ হিন্দুর জমিদারি ছিল পূর্ববঙ্গে। অথচ তারা বসবাস করত পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। আবার অনেকের পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ উভয়স্থলেই ছিল জমিদারি। এ কারণে তারা দু’দল প্রতিনিধি ও উকিল নিয়োগের ব্যাপারটি অপছন্দ করেছিলেন। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা লেখক, সাংবাদিকরা কলকাতা ছাড়তে পারছিলেন না। যদিও পূর্ববঙ্গ থেকে আসা আয়ের ওপরই তারা নির্ভরশীল ছিলেন। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মক্কেলদের ওপর নির্ভর করতেন। কলকাতার উকিলরা ভয় পেয়ে গেলেন, তারা মনে করলেন, নতুন একটি প্রদেশ মানেই নতুন আরেকটি আদালত। মানে এটা তাদের পসারে ভাগ বসাবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশিরভাগই ছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা। তাছাড়া বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দুরা উভয় বঙ্গে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে বিহারি এবং ওড়িশ্যানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়। বিক্রমপুরের বাবুরা তাদের কেরানির চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তাছাড়া কলকাতার কাছেই ভাগ্যকুলের রায় পরিবারের ছিল কাঁচাপাট ও চালের ব্যবসা। এ কারণে চট্টগ্রামের সম্ভাব্য উত্থানে তাদের হিংসা হয়।
এই প্রেক্ষাপটে বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলন যতই চাঙ্গা হচ্ছিল বাংলাদেশ অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সহসা সৌভাগ্যের বিজলী মলিন হয়ে আসছিল। এমনকি শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলো। তাতে কেবল এই বাংলার মুসলিম নয়, হিন্দু-মুসলিম সবারই ভাগ্যাকাশে অবসাদ ছেয়ে গেল। বাংলা আর আসাম নিয়ে গঠিত এই বঙ্গের রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারতÑতা হলো না। ফলে এ অঞ্চলবাসী বিশেষ করে মুসলিমরা আবারও সংকটে পড়ল। তখন নওয়াব সলিমুল্লাহ অন্তত এই অঞ্চলের কিছুটা উন্নতি বহাল রাখার জন্য ইংরেজদের কাছে নিবেদন করলেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইংরেজরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন। ফলে এ অঞ্চলের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সমূহ উন্নয়ন সাধিত হলো; সে আলোচনা পূর্বে হয়েছে। কার্যত, পূর্ব বাংলার কৃষিজীবীদের সন্তানরা নিজেদের ভাগ্য নিয়ে সচেতন হতে শিখল। এই আত্মসচেতনতা স্বপ্ন দেখতে শেখাল। তাদের প্রাণে আকাক্সক্ষা জাগল। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য একটি স্বাধীনতা বা নিজেদের শাসন প্রয়োজন ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে তারা পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলন শুরু করলেন।
পাকিস্তান সৃষ্টি হলো। তখন ১৯৪৭। এই নবগঠিত পূর্ব-পাকিস্তানে সবকিছু পাল্টে যেতে শুরু করল। দেশ ভাগের আগে সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালি মুসলমান ছিল না বললেই চলে। অফিসার কথা বাদ দিতে হবে; বস্তুত জওয়ানের সংখ্যাও ছিল অতি নগণ্য। পুলিশ কর্মকর্তা কিছু ছিল। তবে ১৯৪৭ সালের হিন্দু পুলিশ অফিসার ও সিপাহিরা ভারতে চলে যায়। তাতে করে এদেশের থানা পাহারা দেওয়ার মতো পুলিশেরও অভাব দেখা দিল। সিভিল সার্ভিসে একজন মাত্র আইসিএস মানের বাঙালি মুসলমান ছিলেন। তিনি প্রমোশন পেয়ে এই পদে উঠেছিলেন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান শিক্ষকদের সংখ্যা অতি নগণ্য হয়ে পড়ল। ফলে বাঙালি বা বাঙালি মুসলিমদের জন্য কিছুটা হলেও চাকরি-বাকরির সুযোগ তৈরি হলো।
কার্যত, ভারত যদি বিভক্ত না হতো তাহলে আজকাল যারা সরকারি অফিসে বড় বড় পদ দখল করে বসে আছেন তাদের অনেকেই কেরানি থেকে প্রমোশন পেয়ে বড়জোর সেকশন অফিসার পর্যন্ত উন্নতি করতে পারতেন। অথচ পাকিস্তান সৃষ্টির পরে অনেক বাংলাদেশি জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ার হওয়ার সুযোগ পেলেন।
তাছাড়া এদেশিদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা শিক্ষক হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে, যার বীজও বপন হয়েছিল ঢাকাকে রাজধানী করে কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন একটি প্রশাসনিক কাঠামো বানানোর ভেতর দিয়ে।
যাহোক, ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা ও আমদানি-রফতানির ময়দানে ঢাকাবাসীর স্বপ্নপূরণের নতুন আমেজ তৈরি হলো। ঢাকা তখন রাজধানী। সবার চোখেমুখে তখন স্বপ্নপূরণের চূড়ান্ত ক্ষণ।
জেলা শহর থেকে ঢাকা শহর যখন রাজধানীর মর্যাদা পেল, তখন রাজধানী ঢাকা এবং পুরো দেশব্যাপী উন্নয়নের প্রয়োজন দেখা গেল। চারদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেল।
নতুন রাষ্ট্রের এই বিপুল উন্নয়ন সমারোহে দক্ষকর্মী চাহিদার বাজারে জহুরুল ইসলাম একজন মেট্রিকুলেশন পাস করা যুবক। তাই তার জন্য চাকরিটা ছিল কিছুটা সহজসাধ্য। এমনকি তিনি তখন চাকরি প্রাপ্তির অধিকার রাখতেন। এই সময়ের দক্ষ লোকবলের অভাবের বাজারে জহুরুল ইসলাম নিজের ও তার বাবার পছন্দমতো চাকরি পেয়ে গেলেন। শেখার মানসিকতা নিয়ে তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন। এই পেশা তাকে ভবিষ্যৎ ব্যবসায় জীবনে রসদ জুগিয়েছে।

লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ