রহমত রহমান: দেশের অভিজাত ঢাকা ক্লাবের বিরুদ্ধে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ১০ বছরের নিরীক্ষায় এ ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে। রাজস্ব আদায়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাব জব্দে এনবিআরের অনুমতি চেয়েছে সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারেট। তবে ক্লাব কর্তৃপক্ষ পুনর্নিরীক্ষার অনুরোধ করেছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ঢাকা ক্লাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেবার বিপরীতে কোনো মূসক ও অ্যালকোহল বিক্রির বিপরীতে কোনো সম্পূরক শুল্ক দেয়নি এবং কোনো মূসক নিবন্ধনও নেয়নি। এনবিআর ১৯৯৬ সালে মূসক নিবন্ধন নিতে বাধ্য করে। কিন্তু সঠিকভাবে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক দেয়নি ক্লাবটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে তা তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। মূসক নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এবং কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ) নিরীক্ষা করে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটিত করে। পরে পৃথক চারটি মামলা হয়। মূসক গোয়েন্দার মামলায় দাবি প্রায় ৬৫ কোটি টাকা ও ৫২ কোটি টাকা। আর ভ্যাট কমিশনারেটের মামলায় দাবি প্রায় সাত কোটি টাকা ও প্রায় ২৭ কোটি টাকা।
মূসক গোয়েন্দার ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রথম নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ক্লাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কযোগ্য সেবা প্রদান করে আসছে, কিন্তু তা পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানটি অ্যালকোহল বিক্রির আড়ালে বিপুল রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে। সেজন্য প্রতিষ্ঠানটির অ্যালকোহল আমদানির লাইসেন্স, বার্ষিক প্রাপ্যতা ও বিক্রি অনুযায়ী সরবরাহ গ্রহণের তথ্যাদি সংশ্লিষ্ট বন্ড কমিশনারেটের মাধ্যমে অনুসন্ধানের সুপারিশ করা হয়। ঢাকা ক্লাব সদস্য ফি (নতুন ও নবায়ন), হল বুকিং ও ভাড়া, এটিএম বুথ, ব্যাংক, বেকারি, বিউটি পার্লার, লন্ড্রি, কার্ড রুম, ক্লাব বাজার, গেস্ট হাউজ, হেলথ সেন্টার, মেস, সো সাইন কর্নার ও সুইমিং পুল সেবা প্রদান থেকে বিপুল পরিমাণ আয় করে। এসব সেবার ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূসক প্রযোজ্য। এছাড়া ক্লাবের বারের অ্যালকোহলের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও বিক্রির ওপর ১৫ শতাংশ মূসক প্রযোজ্য। ক্লাবটি লিমিটেড হওয়ায় এর এসব সেবার মোট প্রাপ্তির ওপর মূসক, সম্পূরক শুল্ক ও সম্পদের সংযোজনের ওপর মূসক প্রযোজ্য।
প্রতিবেদনে বলা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় দেড় কোটি টাকার মূসক, প্রায় ৬৩ লাখ টাকার সম্পূরক শুল্ক এবং অ্যালকোহল বিক্রির ওপর প্রায় এক কোটি টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় প্রায় দুই কোটি টাকার মূসক, প্রায় এক কোটি টাকার সম্পূরক শুল্ক ও অ্যালকোহল বিক্রির ওপর প্রায় দুই কোটি টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে। এ সময়ে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার মূসক ও প্রায় এক কোটি টাকার সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই কোটি টাকার মূসক, প্রায় দুই কোটি টাকার সম্পূরক শুল্ক এবং অ্যালকোহল বিক্রির ওপর প্রায় তিন কোটি টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে। এ সময়ে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার মূসক ও প্রায় দুই কোটি টাকার সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই কোটি টাকার মূসক, প্রায় তিন কোটি টাকার সম্পূরক শুল্ক ও অ্যালকোহল বিক্রির ওপর প্রায় পাঁচ কোটি টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সেবার বিপরীতে আয় করলেও কোনো মূসক এবং সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করেনি। ২০১১ সালে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার মূসক পরিশোধ করে। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে। এর ওপর দুই শতাংশ হারে সুদ প্রায় ২৯ কোটি টাকা। এ সময়ে ঢাকা ক্লাব সুদসহ মোট প্রায় সাড়ে ৪৬ কোটি টাকার মূসক ও সুদসহ প্রায় ১৭ কোটি টাকার সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি লিমিটেড কোম্পানি হওয়ায় বিভিন্ন ব্যয়ের ওপর উৎসে মূসক প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠানটি প্রিন্টিং ও স্টেশনারি, বিনোদন, এজিএম, বিজ্ঞাপন, ফটোগ্রাফ, ওয়াশিং, নামফলক ও বোর্ড মেটাল, ক্রেস্ট, কনসালটেন্সি ফি, কেব্ল টিভি, সফটওয়্যার সার্ভিসেস চার্জ, লিগ্যাল ফি, নিরীক্ষা ফি, কুরিয়ার, রিপেয়ার ও রেনুয়েল ব্যয়, বিল্ডিং ও অবকাঠামো মেরামত, বৈদ্যুতিক, আসবাবপত্র, এসি ও ফ্রিজ, ক্রীড়া, কোকারি পণ্য, সাউন্ড ও লাইটে ব্যয় করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৯ লাখ টাকা, ২০০৮ থেকে ২০০৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১৪ লাখ, ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৩ লাখ এবং ২০১০ থেকে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৯ লাখ টাকার উৎসে মূসক ফাঁকি দিয়েছে। এ সময়ে সুদসহ প্রায় দেড় কোটি টাকার উৎসে মূসক ফাঁকি দিয়েছে। ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি সুদ প্রায় ৪১ কোটি টাকাসহ প্রায় ৬৫ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে।
অপর প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১১ থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মূসক প্রায় আড়াই কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক প্রায় দুই কোটি টাকা এবং অ্যালকোহল বিক্রির ওপর মূসক প্রায় আড়াই কোটি টাকা ফাঁকি দিয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মূসক প্রায় আড়াই কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক প্রায় দেড় কোটি টাকা এবং অ্যালকোহল বিক্রির ওপর প্রায় আড়াই কোটি টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মূসক প্রায় দুই কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক প্রায় দেড় কোটি টাকা এবং অ্যালকোহল বিক্রির ওপর মূসক প্রায় আড়াই কোটি টাকা ফাঁকি দিয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মূসক প্রায় তিন কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক প্রায় দেড় কোটি টাকা ও অ্যালকোহল বিক্রির ওপর মূসক প্রায় আড়াই কোটি টাকা ফাঁকি দিয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মূসক প্রায় তিন কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক প্রায় দেড় কোটি টাকা ও অ্যালকোহল বিক্রির ওপর প্রায় দুই কোটি টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর প্রায় সাড়ে ২৩ কোটি টাকা মূসকের মধ্যে মাত্র এক কোটি ১৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে। সুদসহ মূসক প্রায় ৩৭ কোটি টাকা এবং সাড়ে ১১ কোটি টাকার সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে।
অপরদিকে সেবার ওপর ২০১১ থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৭ লাখ টাকা, ২০১২ থেকে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪১ লাখ, ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩১ লাখ, ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৮ লাখ, ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই কোটি এবং সুদসহ প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার উৎসে মূসক ফাঁকি দিয়েছে। ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৩৭ কোটি টাকার মূসক, সাড়ে ১১ কোটি টাকা সম্পূরক শুল্ক ও সাড়ে তিন কোটি টাকার উৎসে মূসকসহ প্রায় ৫২ কোটি টাকা ফাঁকি দিয়েছে। এছাড়া ভ্যাট দক্ষিণ কমিশনারেট প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা ও প্রায় ২৭ কোটি টাকার পৃথক দুটি মামলা এবং দাবিনামা জারি করেছে।
এ বিষয়ে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকার (দক্ষিণ) কমিশনার কাজী মোস্তাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ঢাকা ক্লাব সেবার ওপর মূসক, উৎসে মূসক ও অ্যালকোহল বিক্রিতে সম্পূরক শুল্ক ও মূসক দেয় না। আমরা দুটি ও মূসক গোয়েন্দা দুটি মামলা করেছি। প্রতিষ্ঠান অজুহাত দেখায়, সদস্যদের কাছ থেকে ভ্যাট নেয় না, তাই তারা কীভাবে দেবে? মামলার পরও ভ্যাট দিচ্ছে না, আমরা আরও মামলা করব। ব্যাংক হিসাব জব্দ করে টাকা আদায়ে আমরা এনবিআরের সহযোগিতা চেয়েছি। প্রতিষ্ঠানটি পুনর্নিরীক্ষার অনুরোধ করেছে। তবে এনবিআর ক্লাব কর্তৃপক্ষকে ডেকেছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে ঢাকা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আফজাল রহমান সিনহা কায়সারের ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন দেওয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। পরে মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠালেও জবাব দেননি। ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি আবদুর রাজ্জাক শেয়ার বিজকে বলেন, আমাদের টপ ম্যানেজমেন্ট বিষয়টি নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে কাজ করছে। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।