Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 2:25 am

ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোর উন্নয়নে উল্টোপথে বাংলাদেশ!

ইসমাইল আলী: দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরকে। এ রুটে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন সবচেয়ে বেশি চলাচল করে। অথচ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক রয়ে গেছে চার লেনেরই। যদিও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মহাসড়ক ছয় বা আট লেনের এক্সপ্রেসওয়েতে উন্নীত করতে প্রকল্প নেয়া হয়েছে বা প্রক্রিয়াধীন আছে। আবার মিটারগেজ হওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ট্রেনের গতি কম। আর মিটারগেজ রেলপথ আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটিরও উপযুক্ত না।

সাধারণ চার লেনের মহাসড়ক হওয়ায় সব ধরনের যানবাহন একই সঙ্গে চলাচল করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। আর রেলপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে অনেকটা ঘুরে ৩২০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয়। এতে ৭-৮ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ করিডোর এভাবেই পিছিয়ে পড়ছে। এমনকি এ রুটের উন্নয়নে বর্তমানে বড় কোনো ধরনের পরিকল্পনাও নেই।

কয়েক বছর আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে এক্সপ্রেসওয়ে ও হাইস্পিড ট্রেন চালুর জন্য পৃথক পরিকল্পনা নেয়া হলেও তা ভেস্তে গেছে। এক্ষেত্রে এক্সপ্রেসওয়েতে ২ ঘণ্টায় ও হাইস্পিড ট্রেনে ১ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া যাবে। তবে সম্ভাব্য যাচাই ও নকশা প্রণয়ন করা হলেও প্রকল্প দুটি বাতিল হয়ে গেছে। যদিও এ কাজে ব্যয় হয়েছে তথা গচ্চা গেছে প্রায় ২১০ কোটি টাকা।

সূত্রমতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যানবাহনের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল মহাসড়কের পাশে ছয় লেনের পৃথক এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয় এক দশক আগে। এজন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নও করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে হাইস্পিড ট্রেন চালুর উদ্যোগও নেয়া হয়। এজন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নে পৃথক প্রকল্প নেয়া হয়। এ প্রকল্পে ব্যয় হয় ১১০ কোটি টাকার বেশি। প্রকল্প দুটির অগ্রগতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হলে তিনি এক্সপ্রেসওয়ে ও হাইস্পিড রেলপথের সেতুগুলো সমন্বিতভাবে নির্মাণের পরামর্শও দিয়েছিলেন।

এরপর হঠাৎ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে সরকার। এর পরিবর্তে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে শুধু হাইস্পিড ট্রেন চালুর পরিকল্পনা নেয়া হয়। মূলত রেলওয়ের চাপে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে রেলের পক্ষ থেকে যুক্তি দেয়া হয়, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হলে হাইস্পিড ট্রেনে কাক্সিক্ষত যাত্রী পাওয়া যাবে না।

যদিও হাইস্পিড ট্রেন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন তথা প্রায় এক লাখ কোটি টাকা না পাওয়ায় এ প্রকল্পটিও ঝুলে গেছে। এছাড়া হাইস্পিড ট্রেন বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বরং ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে দ্রুত ভিত্তিতে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে মত তাদের।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামছুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুট। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এ রুটে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা জরুরি। কারণ সারাবিশ্বেই এক্সপ্রেসওয়ের ধারণা এসেছে ব্যবসা-বাণিজ্যকে ফ্যাসিলিটেট করার জন্য। গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে যাচ্ছে সরকার। তাই এখনই সময় দেশের সড়ক অবকাঠামোকে প্রস্তুত করে নেয়ার।

তিনি আরও বলেন, হাইস্পিড ট্রেনের জন্য একটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও আয়তন গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের আয়তন এত ছোট যে, চাইলেও এখানে হাইস্পিড ট্রেন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বরং ট্রেন ব্যবস্থা উৎসব তথা ঈদে, পর্যটনকে আকর্ষণ করতে বা একটি নির্দিষ্ট সেগমেন্টকে সুবিধা দিতে পারবে। তবে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হাইস্পিড ট্রেন খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে না।

সূত্রমতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপিতে নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণে পৃৃথক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) চূড়ান্ত করা হয়। এজন্য ‘সাপোর্ট টু ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে’ প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছিল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। তিন ধাপে ৭০০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করত হতো প্রকল্পটির আওতায়। ২০২২ সালে সাপোর্ট টু এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পর মূল নির্মাণকাজ শুরুর কথা ছিল। এক্ষেত্রে পিপিপিতে গ্যারান্টার হতে চেয়েছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বিশ্বব্যাংক।

তথ্যমতে, ২০১৫ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ হাজার যানবাহন চলাচল করত। ২০২০ সালে তা ৬৫ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। ২০৩০ সালে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৮৫ হাজার। বিদ্যমান চার লেনের মহাসড়ক দিয়ে এ চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তাই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা জরুরি। আর এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৮ হাজার ১৮৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। যদিও হাইস্পিড ট্রেন নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকা।

অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এক্সপ্রেসওয়ের। কারণ রেলের একটি সীমাবদ্ধতা হলোÑএটি স্টেশনভিত্তিক ব্যবস্থা। এতে যাত্রীরা একটি নির্দিষ্ট স্টেশনে থেকে ওঠানামা করতে পারেন। কিন্তু যেকোনো স্থানে যাওয়ার জন্য সড়ক আদর্শ ব্যবস্থা। আবার পণ্য পরিবহনসহ যাত্রীদের যে কোনো ধরনের চাহিদা পূরণে সড়ক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই এক্সপ্রেসওয়ে হলো সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান।

যদিও এক্সপ্রেসওয়ে বাতিলের সিদ্ধান্তটি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য মূলত আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য খুবই জরুরি ছিল। এটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল করা আসলে কতটুকু যৌক্তিক, তা আবার বিবেচনা করা দরকার। কারণ এক্সপ্রেসওয়ের ফলে সুবিধা পেত চট্টগ্রাম বন্দর, চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড), মিরসরাই স্পেশাল ইকোনমিক জোন, মহেশখালীর গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী এলএনজি টার্মিনাল, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও আদমজী ইপিজেডের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ও চট্টগ্রাম বন্দর বা গভীর সমুদ্রবন্দর

ব্যবহার নিয়ে যে সম্ভাব্যতা রয়েছে, তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে।

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি বাতিল করতে হয়েছে। তবে এ প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত (রিভাইভ) করা জরুরি। বুলেট ট্রেন প্রকল্প যেহেতু হচ্ছে না আর এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ অনেক কম ব্যয়বহুল তাই সরকারের ইতিবাচক সাড়া পেলেই প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করা যাবে। আর এটির অর্থায়ন পাওয়াও অনেক সহজ হবে।