নজরুল ইসলাম: ঢাকা ট্রেডিং হাউসের মালিক টিপু সুলতানসহ আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) থেকে ২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় এ চার্জশিট দেয়া হয়েছে। শিগগিরই আদালতে এটি দাখিল করা হবে। ২ ফেব্রুয়ারি কমিশন এ অনুমোদন দিয়েছে। দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
চার্জশিটভুক্ত বাকি সাত আসামি হলেন-টিপু সুলতানের স্ত্রী সোহেলী পারভীন, বিডিবিএলের এজিএম দেওয়ান মোহাম্মদ ইসহাক, ভারপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার সৈয়দ নুরুর রহমান কাদরী, সাবেক কর্মকর্তা দীনেশ চন্দ্র সাহা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা শাখার ম্যানেজার এ এইচ এম শাহরিয়ার, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের নবাবপুর রোড শাখার ম্যানেজার মোহাম্মদ আসাদুল ইসলাম খান, কলাবাগান লেক সার্কাস এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, আসামিরা দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় অপরাধ করেছেন।
দুদকের উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান এ মামলাটি তদন্ত করেছেন। ২০১৯ সালের ১১ জুন রাজধানীর পল্টন থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়। দুদকের তফসিলভুক্ত হওয়ায় পরে সেটি দুদক তদন্ত শুরু করে। তদন্ত শেষে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। কমিশন চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দেয়।
দুদক সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ১৬ মে ঢাকার বিডিবিএলের প্রিন্সিপাল শাখায় প্রতিষ্ঠানটির (ঢাকা ট্রেডিং হাউস) নামে একটি হিসাব খোলা হয়। টিপু সুলতান বিডিবিএলের প্রিন্সিপাল শাখায় এলসি লিমিট এবং এলটিআর ঋণ মঞ্জুরের জন্য আবেদন করেন। তিনি একটি এমওইউ-এর কপি বিডিবিএলের প্রিন্সিপাল শাখায় নিয়ে আসেন। সেখানে দেখানো হয়, স্থানীয় বাজার থেকে ১৫ হাজার মেট্রিক টন গম সংগ্রহ করে তা ডাইরেক্টর জেনারেল অব ফুডস, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে সরবরাহ করা হবে। প্রকৃত অর্থে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির কোনো চুক্তি স্বাক্ষর বা এমওইউ হয়নি। টিপু সুলতান সেই জাল কাগজপত্র বিডিবিএলের প্রিন্সিপাল শাখায় উপস্থাপন করলে এমওইউ-এর সঠিকতা যাচাই ব্যতিরেকে শাখা ৩০ কোটি টাকার লোকাল এলসি লিমিট অনুমোদন এবং ২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার এলটিআর ঋণ মঞ্জুর করে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫ কোটি টাকার ঋণটি খুবই দ্রুত অনুমোদিত হয়। এক্ষেত্রে গ্রাহকের পরিশোধ প্রক্রিয়া, দক্ষতা এবং সক্ষমতা যাচাই করা হয়নি। ১৫ হাজার মেট্রিক টন পণ্য এক দিনে একটি ট্রাকে পরিবহন দেখানো হয়েছে, যা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। টিপু সুলতান যে এমওইউ বিডিবিএলে জমা দিয়েছেন, তা জাল ও ভুয়া। তদন্তকালে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের বিজয়নগর শাখা থেকে পাঠানো রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই শাখার গ্রাহক এসপিএস করপোরেশন হলো ঢাকা ট্রেডিং হাউসের লোকাল এলসির বেনিফিশিয়ারি। কিন্তু এসপিএস করপোরেশনের অফিস ঠিকানা এবং ঢাকা ট্রেডিং হাউসের অফিসের ঠিকানা একই।
এসপিএস করপোরেশন মালামাল সাপ্লাইয়ের যে ট্রাকের ডেলিভারি চালান দিয়েছে, সেখানে মেসার্স ঢাকা ট্রেডিং হাউসের মালিকের মালামাল গ্রহণের কোনো প্রমাণ নেই। তিনি ওই কাগজে স্বাক্ষর করেননি। কোন ট্রাকের মাধ্যমে মালামাল পরিবহন করা হয়েছে, তার কোনো ট্রাক নম্বর নেই। কয়টি ট্রাকে ১৫ হাজার মেট্রিক টন গম পরিবহন করা হয়েছে, তাও উল্লেখ নেই। ওই পরিমাণ গম এক দিনে সরবরাহ করতে অন্তত ৫ মেট্রিক টনের ট্রাক হলে কমপক্ষে ৩ হাজার ট্রাক প্রয়োজন হবে। বিডিবিএল ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ওই জাল রেকর্ডপত্রের সঠিকতা যাচাই ছাড়াই গ্রাহক কর্তৃক মালামাল বুঝে পেয়েছে মর্মে সন্তুষ্ট হয়ে বিডিবিএল ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার ম্যানেজার সৈয়দ এন আর কাদরী ২০১২ সালের ৭ জুন ৩০ লাখ টাকা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের বিজয়নগর শাখা বরাবরে পে-অর্ডার করেন। এসপিএস করপোরেশনে অর্থ জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই দিনই শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের বিজয়নগর শাখার গ্রাহক এসপিএস করপোরেশনের হিসাব থেকে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নামে ২০১২ সালের ৭ জুন ৬ কোটি ৮২ লাখ ৪৮ হাজার ৬৭২ টাকা, ১০ জুন টিপু সুলতানের স্ত্রী সোহেলী পারভীনের নামে ৫ কোটি, ৭ জুন মেসার্স ঢাকা ট্রেডিং হাউসের নামে ৯ কোটি, ১৭ জুন মেসার্স ঢাকা ট্রেডিং হাউসের নামে ৯০ লাখ ৫০ হাজার এবং ১৮ জুন ৯০ লাখ ৫০ হাজার টাকা স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ এসপিএস করপোরেশন পরোক্ষভাবে টিপু সুলতানেরই কাগুজে প্রতিষ্ঠান। মালামাল পরিবহন দেখিয়ে জাল কাগজকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকারদের সহায়তায় সঠিক হিসাবে উপস্থাপন করে ওই টাকা আত্মসাৎ ও লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে হস্তান্তর, রূপান্তর করে মানিলন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ত ধারায় অপরাধ করেছেন।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, টিপু সুলতানের গ্রামের বাড়ি বগুড়া সদরের নাটাইপাড়ার হাজী জিল্লুর রহমান সড়কে। ঢাকায় তিনি বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় বাস করেন। তার ঢাকা ট্রেডিং হাউস পুরানা পল্টনের আল রাজী কমপ্লেক্সে।
ঢাকা ট্রেডিং হাউসের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে দুদকে আরও একটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এছাড়া রূপালী ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক থেকে আরও প্রায় ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে এসব অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন দুদক-সংশ্লিষ্টরা।