ইসমাইল আলী: ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ ডাবল লাইন নির্মাণে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) কিছু জমি প্রয়োজন। তবে এ-সংক্রান্ত পরিকল্পনা বা জমি অধিগ্রহণ ব্যয় ছাড়াই প্রকল্পটি নেয়া হয়। আর জমি দিতে রাজিও হচ্ছিল না নাসিক। এতে বাধ্য হয়েই চাষাঢ়া পর্যন্ত ডাবল লাইন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যদিও চার বছর ঘুরিয়ে অবশেষে শর্তসাপেক্ষে জমি দিচ্ছে নাসিক।
সম্প্রতি প্রকল্পটির সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (আরডিপিপি) চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে ২০১৪ সালে গৃহীত প্রকল্পটির মেয়াদ এরই মধ্যে চার দফা বাড়ানো হয়েছে। আরেক দফা প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি প্রকল্পটির ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে প্রায় ৯০ শতাংশ।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে জানানো হয়, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ প্রকল্পটি ২০১৪ সালের জুলাইয়ে শুরু করে ২০১৭ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল। পরে তা কয়েক দফা বৃদ্ধি করে ২০২২ সালের ডিসেম্বর করা হয়েছে। তবে এটি আরও বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রকল্পটি শেষ হতে ১২ বছর লাগবে।
এদিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ১৬ কিলোমিটার ডাবল লাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৭৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। তবে প্রকল্পটির পরিকল্পনায় ছিল বড় ধরনের ভুল। তা সংশোধনে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১৮ কোটি চার লাখ টাকা। অর্থাৎ নির্মাণব্যয় বেড়ে যাচ্ছে ৩৩৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বা ৮৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। যদিও ডাবল লাইন নির্মাণে কমলাপুর থেকে গেন্ডারিয়া পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য কমানো হয়েছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ওই অংশটি ডাবল লাইন করা হবে।
পিইসি বৈঠকে আরও জানানো হয়, ১৮৮২-৮৪ সালে নারায়ণগঞ্জ স্টক ইয়ার্ড থেকে লেভেল ক্রসিং টি/২ পর্যন্ত ৬২ ফুট প্রশস্ত জমি অধিগ্রহণ করা হয়। তাই লেভেল ক্রসিং গেট টি/১ থেকে টি/২ পর্যন্ত ডাবল লাইনের জন্য জমি পাওয়ার বিষয়ে আস্থাবান ছিল রেলওয়ে। যদিও বাস্তবে তা ছিল অবৈধ দখলদারের অধীনে। এছাড়া রেলের জমির একটি অংশ নাসিকের শহীদ সোহরাওয়ার্দী সড়ক নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এতে টি/১ থেকে টি/২ লেভেল ক্রসিং গেট পর্যন্ত ১২-১৩ ফুট জমি অবশিষ্ট ছিল, যা ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণের জন্য উপযুক্ত নয়। এতে জমি অধিগ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
প্রকল্পটির জন্য শূন্য দশমিক ৫১ একর জমি দরকার। এতে আনুমানিক ব্যয় হবে ৮৩ কোটি ৭৬ টাকা। আর স্থাপনা অপসারণে ক্ষতিপূরণ বাবদ আরও ৪৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় হবে। সব মিলিয়ে ব্যয় হবে ১৩৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা। তবে প্রকল্পটিতে এ খাতে কোনো বরাদ্দ ছিল না। তাই জমি অধিগ্রহণ এড়াতে ওই অংশটির জন্য পৃথক সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। এতে নাসিকের মালিকানাধীন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী সড়ক থেকে ৯০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৮ ফুট প্রস্থ ভূমি রেললাইন নির্মাণের জন্য রেলের বরাবর হস্তান্তরের সুপারিশ করা হয়। নাসিক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রাথমিকভাবে এ প্রস্তাবে সম্মত হলেও পরে জমি দিতে অস্বীকৃতি জানান। এতে বাধ্য হয়ে চাষাঢ়া থেকে নারায়ণগঞ্জ বন্দর পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নাসিক এলাকায় এলজিইডি কর্তৃক কদমরসুল সেতু নির্মাণের জন্য রেলের কাছে ১ দশমিক ৬৩ একর জমি চাওয়া হয়। তবে রেলওয়ে ডাবল লাইন নির্মাণে শূন্য দশমিক ১২ একর জমির বিনিময়ে নাসিকের সেতুর জন্য জমি দিতে সম্মত হয়। বিস্তারিত আলোচনার পর রেলওয়ে ও নাসিক জমি হস্তান্তরে সম্মত হয় এবং ওয়াজ বদলে রাজি হয়। বর্তমানে জমি দুটি হস্তান্তর প্রক্রিয়া ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
এদিকে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় কমলাপুর থেকে গেন্ডারিয়া পর্যন্ত চার কিলোমিটার ডাবল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। তাই ওই অংশটি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের ডাবল লাইন প্রকল্প থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এতে লুপ লাইন নির্মাণও আনুপাতিক হারে হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া পাগলা, ফতুল্লা, চাষাঢ়া ও নারায়ণগঞ্জ স্টেশনের ফ্লোরের আয়তন ও ব্যয় বৃদ্ধি এবং পাগলায় একটি প্ল্যাটফর্ম ও দুটি প্ল্যাটফর্ম শেড অন্তর্ভুক্তিসহ অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম শেডের আয়তন ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে তিনটি নতুন ফুটওভার ব্রিজ যুক্ত করা হয়েছে এবং একটি দোতলা অফিস কাম ব্যারাক ও পাঁচটি গ্যাংহাট নতুন সংযোজন করা হয়েছে।
বৈঠকে আরও জানানো হয়, প্রকল্পটির আওতায় বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরালে ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণকাজ চলছে। বিদ্যমান মিটারগেজ লাইনটিতে ৭৫ পাউন্ড রেল ব্যবহার করা হয়েছে। আর নতুন ডুয়েলগেজ লাইনে ৬০ কেজির রেল ব্যবহার করা হচ্ছে। নতুন ডুয়েলগেজ লাইনটি বিদ্যমান রেললাইনের চেয়ে ৩৫২ মিলিমিটার উঁচু। এছাড়া ২৫টি লেভেল ক্রসিং গেটে উচ্চতার পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে। আটটি ক্রসওভারে অসম উচ্চতার কারণে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া লেভেল ক্রসিং গেটগুলোয় অসম উচ্চতার কারণে সড়কে যান আটকে যেতে পারে। এসব সমস্যা পরিহারে নতুন একটি প্যাকেজের মাধ্যমে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনটিও ডুয়েলগেজে রূপান্তর করতে হবে।
বিদ্যমান রেললাইনটি সংস্কারে কোনো রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অন্তর্ভুক্ত ছিল না প্রকল্পটিতে। কিন্তু বাস্তব কাজ করতে গিয়ে কিছু অংশ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়েছে। আবার ডাবল লাইন নির্মাণের জন্য পরামর্শক চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে হবে। সব মিলিয়ে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।