ইসমাইল আলী: নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে দেশজুড়ে চলছে লকডাউন। ২৬ মার্চ শুরু হওয়া এ লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয়েছে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত। যদিও দুইদিন আগে ঘোষণা দেওয়ায় ২৪ মার্চ রাত থেকেই ঢাকা ছাড়তে শুরু করে মানুষ। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রায় এক কোটি পাঁচ লাখ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ঢাকার বাইরে গেছেন। এর বড় অংশই নিম্ন আয়ের মানুষ। সাধারণত এসব পরিবারে একের অধিক ফোন থাকে না। তাই পরিবারসহ হিসেব করলে ঢাকা ছাড়া মানুষ দেড় কোটির কম হবে না। ঈদের সময় গ্রাম মুখী মানুষের এ ঢলকে বলা হয় নাড়িরটান। তবে এবার তার ব্যতিক্রম। কারণ লকডাউনে সব বন্ধ থাকলে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বা সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের কথা মাথায় রেখেই ঢাকা ছেড়ে যাওয়া।
এ শহর শুধু দুই থেকে সোয়া দুই কোটি মানুষকে ধারণই করে নাই, তাদের জীবন, জীবিকারও ব্যবস্থা করেছে। যদিও ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা আর যানজটে অনেকের নাভিশ্বাস উঠে গেছে, কিন্তু জীবন জীবিকার তাগিদে এসবের সঙ্গে মানুষ খাপ খাইয়েও নিয়েছে। এ শহর খালি হয়ে গেলে যেমন বাড়িওয়ালারা বিপদে পড়বেন তেমনি অনেক পেশার মানুষ (যেমন-রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা, বাসাবাড়িতে কাজের মানুষ) কর্মহীন তথা আয়হীন হয়ে পড়বে। তাই এ শহরবাসী একে অপরের পরিপূরক হয়ে আছে।
এখন দেখা যাক ঢাকার ওপর দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির নির্ভরশীলতা। লকডাউনে এতো বিশাল জনগোষ্ঠীর ঢাকা ছাড়ার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের অন্যান্য জনপদে। ঢাকার অদূরে গাজীপুরের পোল্ট্রি শিল্পে ধস নামতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ডিমের দাম অনেক কমে গেছে। একই অবস্থা ডেইরি শিল্পেও। দুধের দাম নেমে গেছে ৫ টাকা প্রতি লিটার। মাছ, সবজির দামও নেমে যাচ্ছে। পাড়ায়, মহল্লায় চায়ের দোকান থেকে শুরু করে শপিংমল সবই ঢাকার জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল। আর এসবের ওপর নির্ভর করছে কর্মসংস্থান ও শিল্প পণ্যের বড় ধরনের বাজার। পরিবহন, সেবা খাত আর প্রবৃদ্ধির চাকাও এর ওপর ভিত্তি করে ঘোরে।
শুধু ভিক্ষা করে এ শহরে কত মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে তারই কোনো হিসেব নেই। ঢাকাবাসীর আয়ের ওপর অর্থনীতির চাকা এভাবেই ঘুরছে। শুধু অর্থনীতি না রাজনীতি, প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সবই ঢাকাভিত্তিক। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধানতম আকর্ষণীয় কেন্দ্রগুলোও ঢাকামুখী। এ শহরের মানুষের ব্যয় প্রবণতা এমনকি উৎসবমুখী আচরণও অনেক গুরুত্ব বহন করে। এছাড়া বিলাসবহুল হোটেল, রেস্তোরাঁ আর দামী ব্র্যান্ডের গাড়ি এমনকি ফুড চেইন শপগুলোও ঢাকা কেন্দ্রিক। তাই ঢাকা স্থবির হয়ে যাওয়া মানে দেশের অর্থনীতির চাকাও থেমে যাওয়া। এক সময় বলা হতো ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে দেশ বাঁচবে। এখন বাস্তবতা ভিন্ন। এখন বলতে হবে ঢাকা বাঁচলে দেশ বাঁচবে।
এটা সত্য যে, শুধু জীবিকার তাগিদে অনেকে ঢাকা ছাড়তে পারছেন না। যদিও এ শহর তাদের নাভিশ্বাসের জায়গা। তবে এটাও সত্যি স্বাধীনতার ৪৯ বছরে আমরা ঢাকার বিকল্প মাঝারি মানের কোনো শহর এখনো গড়ে তুলতে পারিনি। তাই সময় এসেছে বিকল্প চিন্তার। ঢাকার বিকল্প মাঝারি মানের কিছু শহর গড়ে তুলে ঢাকার ওপর চাপ কমানোর। না হলে কোনো দুর্যোগ এ শহরে আঘাত হানলে তা পুরো অর্থনীতিকে ধসিয়ে দেবে। নীতি নির্ধারকরা বিষয়টি নিয়ে এখনই পরিকল্পনা করতে পারেন।
গণমাধ্যমকর্মী