আবদুল হাকিম আবির: ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুসারে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন ছাড়া কোনো ধরনের ভবন নির্মাণ নিষিদ্ধ। কিন্তু এ আইন লঙ্ঘন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে একের পর এক বহুতল ভবন নির্মাণ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজউকের কোনো ধরনের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। ফলে নির্মাণের কয়েক বছর না যেতেই অনেক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। এছাড়া এসব ভবনে নেই অগ্নিকাণ্ড, ভ‚মিকম্প, বজ্রপাত, ভবনধসসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও।
ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা ২০০৮-এর ১৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বা সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা নতুন ভবন বা অবকাঠামো নির্মাণ করিতে বা বিদ্যমান ভবন বা অবকাঠামো পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংযোজন করিতে ইচ্ছুক হইলে আইন অনুযায়ী নির্মাণ অনুমোদনপত্র গ্রহণ করিতে হইবে।’ এ ধারার অন্য ১১টি উপ-ধারায় ভবনের নকশা সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে, যার কোনোটিই মানে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (প্রজেক্ট অ্যান্ড ডিজাইন) মো. আনোয়ার হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ঢাকা শহর ও আশপাশের রাজউক এলাকার মধ্যে কেবল ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ভবন নির্মাণের অনুমোদন সংশ্লিষ্ট ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড অনুমোদন দিয়ে থাকে। এর বাইরে সব এলাকাই রাজউকের নিয়ম মানতে বাধ্য। ফলে রাজউকের আওতাভুক্ত এলাকায় হওয়ায় সব নিয়মকানুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভবন নির্মাণে কখনও রাজউকের নিয়ম-নীতি মানে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণসংক্রান্ত নকশা অনুমোদন ও পর্যালোচনার জন্য উপাচার্যের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যসচিব হন বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্তাবধায়ক প্রকৌশলী। সদস্য হিসেবে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, উপাচার্য মনোনীত একজন সিন্ডিকেট সদস্য, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার পরিচালক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদের ডিন এবং স্থাপত্য অধিদফতরের প্রধান স্থপতি।
সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ১৯টি আবাসিক হল ও তিনটি হোস্টেল রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে তৈরি। তবে নির্মাণাধীন শেখ রাসেল টাওয়ারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভবন নির্মাণেই রাজউক দ্বারা নকশা অনুমোদন করানো হয়নি। আর সাম্প্রতিককালে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টাওয়ার, কবি সুফিয়া কামাল হল, বিজয় একাত্তর হল, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ভবনসহ অন্য ভবনগুলোরও একই অবস্থা। বিভিন্ন একাডেমিক ভবনগুলোর অবস্থাও একই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কার্যক্রম অবশ্যই আইনসিদ্ধ নয়। তারা কোনো নিয়মকানুন না মেনেই নিজেদের মতো করে ভবন নির্মাণ করছে। আমরাসহ আরও কিছু পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কয়েকবার অনুরোধ করা হয়েছে, প্রস্তাবনাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা লঙ্ঘন করেই চলছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১২ সালে নির্মিত বিজয় একাত্তর হলে ইতোমধ্যে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ হলের বিভিন্ন অংশে ইতোমধ্যে পলেস্তারা খসে পড়াসহ অনেক ধরনের ক্ষতি খালি চোখেই দেখা যায়। এর আগে নির্মাণাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের সিকদার মনোয়ারা ভবনে ফাটল ধরলে অর্ধনির্মিত অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে প্রায় পরিত্যক্ত ফেলে রাখা হয়েছে। এখন এর কিছু অংশ রিডিং রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এদিকে সম্প্রতি নির্মিত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ৭২টি ফ্ল্যাটসংবলিত বিশতলা বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের মূল সিঁড়ি মাত্র একটি। অতিরিক্ত সিঁড়ির প্রস্থ মাত্র দেড় ফুট। এছাড়া ২০১৩ সালে চালু হওয়া ছয়তলার সামাজিক অনুষদ ভবনটিও করা হয়েছে ত্রæটিপূর্ণ নকশার মাধ্যমে। সম্প্রতি নির্মাণকাজ শেষ হওয়া সাত মার্চ ভবনসহ উল্লিখিত ভবনগুলোর নকশা রাজউক কর্তৃক অনুমোদন করানো হয়নি।
রাজউকের অনুমোদন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী একেএম আফজালুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি নিজেকে অসুস্থ দাবি করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষজ্ঞ দলের মাধ্যমে আমরা যেভাবে নকশার অনুমোদন করি, তাতে কোনো ত্রুটি থাকে না।