সাঈদ হাসান: বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সিদ্দিকুর রহমান ‘তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯’-এর আওতায় বানারীপাড়া উপজেলার ২নং ইলুহার ইউনিয়নের ৪০ দিনের কর্মসূচির বিভিন্ন প্রকল্পের ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ, সিপিসির নাম, মাস্টাররোল, লেবারদের তালিকা প্রভৃতি তথ্য চেয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কাছে বিধিমোতাবেক আবেদন করেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য না পেয়ে তিনি ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ও আপিল কর্তৃপক্ষের (আরটিআই) কাছে আপিল আবেদন করেন। তথ্য অধিকার আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য না পেয়ে সিদ্দিকুর রহমান ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি বিধিমোতাবেক তথ্য কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেন। তথ্য কমিশনের ২০২০ সালের ৩ মার্চের নিয়মিত সভায় অভিযোগটি পর্যালোচনান্তে শুনানির জন্য গ্রহণ করা হয়। কভিড মহামারির কারণে সরকার কর্তৃক সাধারণ ছুটি ঘোষণা হওয়ায় নির্ধারিত তারিখে শুনানি সম্ভব না হওয়ায় ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করা হয়। সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য কমিশন ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর আবার শুনানির দিন ধার্য করেন এবং ওইদিন উভয়পক্ষকে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে (জুম অ্যাপ ব্যবহার করে) হাজির হয়ে বক্তব্য রাখার জন্য সমন জারি করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা হাজির থাকায় আবার ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়। নির্ধারিত সময়ে উভয়পক্ষ জুম অ্যাপের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন। উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে তথ্য কমিশন তথ্য প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তাকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে তথ্য প্রদানের নির্দেশ দেন। এছাড়া তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তাকে অসহযোগিতার জন্য তিন হাজার টাকা জরিমানা করেন। তথ্য কমিশনের এটি একটি নিয়মিত কার্যক্রম। করোনা অতিমারির সময়ও তথ্য কমিশন তাদের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাসহ নানা ধরনের সমস্যার মধ্যেও তথ্য অধিকার আইনের আওতায় জনগণের অধিকার আদায়ে নিয়মিত কাজ করেছে এবং করছে।
দেশে এক হাজার একশ’র বেশি আইন আছে। এসব আইনে নাগরিকরা কী করতে পারবে, আর কী করতে পারবে না বা কতটুকু করতে পারবে, তা উল্লেখ আছে। এসব আইন জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে। তথ্য অধিকার আইন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এ আইনের অধীনে তথ্য না দিলে বা বাধা দিলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শাস্তি দেয়ার বিধান রয়েছে। জনগণকে যেসব সেবা দেয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারি বা বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত সংস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে, তারা সঠিকভাবে জনগণকে সেবা দিচ্ছে কি না, বা জনগণ সে সুবিধা যথাযথভাবে পাচ্ছে কি না, তা জানার অধিকার তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে জনগণকে দেয়া হয়েছে। তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে জনগণের কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটি জনবান্ধব আইন। শুধু আটটি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ব্যতীত সব সরকারি-বেসরকারি এবং বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত সংস্থায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে দুর্নীতি হ্রাস ও সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা তথ্য অধিকার আইনের মূল লক্ষ্য। এ আইনের ৭ ধারায় উল্লেখিত বিষয় ব্যতীত সব তথ্য জনগণকে দেয়া বাধ্যতামূলক। এছাড়া ৬ ধারা অনুযায়ী জনগণের কাছে সহজলভ্যভাবে তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী সব দপ্তরে তথ্য প্রদানের জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য না দিলে আপিল করার সুযোগ আছে। আপিল কর্মকর্তাও নির্ধারণ করে দেয়া আছে। আপিল কর্মকর্তার কাছে প্রতিকার না পেলে তথ্য কমিশনে অভিযোগ করার সুযোগ আছে। বরিশালের বানারীপাড়ার সিদ্দিকুর রহমান তথ্য অধিকার আইনের এ সুযোগ গ্রহণ করেছেন এবং প্রতিকার পেয়েছেন। বিবেচ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছিল কি না সেটি মূলবিষয় নয়, মূলবিষয় হলো তথ্য না দেয়ার মানসিকতা। সমাজের সব ক্ষেত্রে এ মেসেজটি দেয়া সম্ভব হলে সবাই স্বচ্ছতার সঙ্গে বিধিমোতাবেক কাজ করতে বাধ্য হবে এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে দুর্নীতি হ্রাস পাবে। তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ সহজলভ্যতাকে সংকুচিত করতে পারবে নাÑএ বিষয়ে তথ্য কমিশনের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
গণশুনানির মাধ্যমেও দুর্নীতি হ্রাস করা সম্ভব। সরকারি দপ্তরগুলোয় নিয়মিত সেবাগ্রহীতাসহ সব স্তরের জনগণের উপস্থিতিতে গণশুনানির আয়োজন করা হয়। সেবাগ্রহীতাদের মতামত ও পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়ে থাকে। তবে করোনাকালে সরাসরি গণশুনানির আয়োজন আগের মতো সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ভারচুয়ালি গণশুনানির আয়োজন করা যেতে পারে। তথ্য জনগণকে সচেতন করে, ক্ষমতায়িত করে এবং দুর্নীতি হ্রাস করে। তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সব দপ্তরে স্বপ্রণোদিত হয়ে তথ্য প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। এজন্য স্বপ্রণোদিত তথ্যে গণশুনানির মাধ্যমেও দুর্নীতি হ্রাস করা সম্ভব। সরকারি দপ্তরগুলোয় নিয়মিত সেবাগ্রহীতাসহ সব স্তরের জনগণের উপস্থিতিতে গণশুনানির আয়োজন করা হয়। সেবাগ্রহীতাদের মতামত ও পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়ে থাকে। তবে করোনাকালে সরাসরি গণশুনানির আয়োজন আগের মতো সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ভারচুয়ালি গণশুনানির আয়োজন করা যেতে পারে। তথ্য জনগণকে সচেতন করে, ক্ষমতায়িত করে এবং দুর্নীতি হ্রাস করে। তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সব দপ্তরে স্বপ্রণোদিত হয়ে তথ্য প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। এজন্য স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ নির্দেশিকা, ২০১৪ জারি করা হয়েছে। টিআইবি’র গবেষণা অনুযায়ী স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশে বেসরকারি সংস্থার চেয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ এগিয়ে আছে।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ১৬.৬ এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সকল পর্যায়ে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠানের উন্নতি ঘটানো।’ সবার জন্য ন্যায়বিচারের সুযোগ প্রদান করা এবং সর্বস্তরে কার্যকর জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের সহায়ক শক্তি হিসেবে তথ্য কমিশন ভূমিকা রাখছে। দুর্নীতিকেই বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া দুর্নীতিকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবেও দেখা হয়। কারণ উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত সব দেশেই দুর্নীতি রয়েছে। তবে উন্নত দেশগুলো তাদের নাগরিকদের জন্য সচেতনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। এসব দেশে তথ্যের আদান-প্রদান এবং তথ্যের চাহিদা বৃদ্ধি বজায় রাখার মাধ্যমে দুর্নীতিকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, ঠিক তেমনই সুশাসনও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী গণসচেতনতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন দপ্তর ও অধিদপ্তরগুলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠনের লক্ষ্যে জনগণকে সচেতন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে দুর্নীতির মাত্রা জন-আকাক্সক্ষা অনুযায়ী কমেনি। তবে আশার কথা হলো মানুষ দুর্নীতিকে ঘৃণা করে, সমাজের সকল স্তর থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কম-বেশি প্রতিবাদ করা হচ্ছে এবং সবাই কথা বলছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনও সীমিত সম্পদ নিয়ে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইন ও বিধিমোতাবেক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন সমাজে সততা ও নিষ্ঠাবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে বহুমাত্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
দেশের মোট জনসমষ্টির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ তরুণ। এই বিশাল সংখ্যক যুবসমাজই আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পারলে প্রধানমন্ত্রীর উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহায়ক হবে। সংশ্লিষ্ট সবার প্রচেষ্টার মাধ্যমে দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, এটা একটা যুদ্ধ, আর তাই এ যুদ্ধে আমাদের এক হয়ে কাজ করতে হবে।
পিআইডি নিবন্ধন