তথ্যপ্রযুক্তি ও গবেষণায় বাংলা ভাষা ব্যবহার প্রকল্পে গতি নেই

জাকারিয়া পলাশ হামিদুর রহমান: সংস্কৃতির চর্চায় বিশ্বজুড়ে বাড়ছে বাংলার ব্যবহার। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে এ ভাষা আজ ৩০টি দেশের ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও চর্চার বিষয়। যদিও দেশে তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) ও গবেষণায় বাংলা ভাষার ব্যবহার নেই বললেই চলে। এজন্য বছর দেড়েক আগে নেওয়া হয় ‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধকরণ’ প্রকল্প। তবে সভা-সেমিনারে আটকে আছে ১৫৯ কোটি টাকার প্রকল্পের অগ্রগতি।

১৬টি ক্ষেত্রে সফটওয়্যার, টুলস বা রিসোর্স উন্নয়নের কথা রয়েছে প্রকল্পটির আওতায়, যা বাস্তবায়িত হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। এছাড়া বাংলা স্টাইল-শিটও করা হবে প্রকল্পটির আওতায়। এতে বিশ্বমানের বাংলা কম্পিউটিংয়ের ভিত্তি তৈরি হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এগুলোর কোনো অগ্রগতিই হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলা ভাষার রচিত রবীন্দ্র রচনাবলির ৩৩ খণ্ডের অনুবাদ হয়েছে চীনা ভাষায়। এছাড়া লালনের গান ও দর্শন ইংরেজি এবং জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সোভিয়েত আমলে রুশ ভাষাতে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের ব্যাপক অংশের অনুবাদ হয়েছে। কিন্তু দেশে গবেষণা ও আইসিটিতে বাংলা ব্যবহার পিছিয়ে থাকাটা দুঃখজনক। যদিও বাংলা ভাষা পৃথিবীতে প্রভাবশালী ভাষাগুলোর একটি।

জানা যায়, কম্পিউটিং ও আইসিটিতে বাংলা ভাষাকে খাপ খাওয়ানোর জন্য গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলা ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। এজন্য ১৫৯ কোটি টাকা ২০১৬ সালের জুলাইয়ে সরকার অনুমোদন করে। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি মাধ্যমে (ওয়েব, মোবাইল, কম্পিউটার) ব্যবহারযোগ্য বিভিন্ন সফটয়্যার/টুলস/রিসোর্স উন্নয়ন করা। অর্থাৎ এর মাধ্যমে বাংলা ভাষা কম্পিউটারে ব্যবহার করতে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা নিরসন সম্ভব হবে বলে আশা করা হয়েছিল।

দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটির অফিস স্থাপনই সম্পন্ন হয়নি। আগারগাঁওয়ে আইসিটি ভবনে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের অফিসে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্প কাজের জন্য অফিস কক্ষগুলো সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়নি। পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রয়োজন অনুযায়ী জনবল নেই। মাত্র দুই কর্মকর্তা ও সাত কর্মচারী রয়েছে প্রকল্পটিতে। তবে তাদের বাস্তব কোনো কাজ নেই।

এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের পরিচালক মো. ছরোয়ার মোস্তফা চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘প্রকল্পে বলার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি। নীতিগত পর্যায়ে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তাছাড়া কিছু সভা-সেমিনারের মাধ্যমে এ প্রকল্পটি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের জানানোর চেষ্টা করেছি আমরা। এখনও প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করা হয়নি।’

প্রকল্পের তথ্যমতে, গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পে আওতায় ১৬টি উপাংশ রয়েছে। এগুলো হলো আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে পূর্ণাঙ্গ বাংলা করপাস উন্নয়ন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ কর্তৃক তৈরি করা বাংলা ‘ওসিআর’-এর সঙ্গে হাতের লেখা শনাক্তকরণ পদ্ধতি একীভূত করা, কথা থেকে লেখা এবং লেখা থেকে কথায় রূপান্তর করার সফটওয়্যার উন্নয়ন, জাতীয় কিবোর্ডের (বাংলা) উন্নয়ন, বাংলা ভাষাশৈলীর নীতি প্রমিতকরণ (স্টাইল গাইড উন্নয়ন), বাংলা ফন্ট আন্তঃক্রিয়া ও রূপান্তর ইঞ্জিন, বাংলা ‘সিএলডিআর’ উন্নয়ন এবং ইউনিকোড কনসোরটিয়ামে জমা দেওয়া, বাংলা বানান ও ব্যাকরণ পরীক্ষক উন্নয়ন, বাংলা যান্ত্রিক অনুবাদক উন্নয়ন, স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার উন্নয়ন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ভাষিক যোগাযোগের জন্য সফটওয়্যার উন্নয়ন, বাংলা অনুভূতি বিশ্লেষণের সফটওয়্যার উন্নয়ন, একটি বহুভাষিক কনটেন্ট রূপান্তর পদ্ধতি ও প্ল্যাটফর্ম উন্নয়ন করা, সবচেয়ে জনপ্রিয়/ব্যবহার করা সাইটগুলো আন্তর্জাতিক ভাষায় অনুবাদ, বাংলা ভিন্ন দেশের অন্য প্রচলিত ভাষা/ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার জন্য প্রমিত কিবোর্ড এবং বাংলা ভাষাসহায়ক ‘আইপিএ’ ফন্ট ও সফটওয়্যার উন্নয়ন।

প্রকল্পের প্রস্তাবনায় জানা যায়, বাংলায় বিভিন্ন টুলস উদ্ভাবনের লক্ষ্যে সম্প্রতি সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা চালানো হয়েছে। সমীক্ষার সুপারিশের আলোকে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ধার নিয়ে ১৬৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়। পরে পরিকল্পনা কমিশনের পর্যালোচনার পর সাড়ে পাঁচ কোটি কমে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ১৫৯ কোটি দুই লাখ টাকা। ২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।

যদিও বাস্তবে কয়েকটি সভা-সেমিনারের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতা চাওয়া ও সচেতনতা তৈরিই ছিল এসব সভা-সেমিনারের লক্ষ্য। তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো কারিগরি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি কোনো সফটওয়্যার উন্নয়নে বিশেষজ্ঞ বা কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মী নিয়োগ করা হয়নি। ফলে গবেষণা ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধির বাস্তব কোনো অগ্রগতি নেই।

 

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০