Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 8:46 pm

তথ্য অধিকার আইনে অধিকার-অনধিকার বিড়ম্বনা

মো. বেলায়েত হোসেন: তথ্য অধিকার আইন ‘বাংলাদেশের আইনি ইতিহাসে একটি মাইলফলক’ হিসেবে অভিহিত। বাংলাদেশে বিদ্যমান সব আইনের মধ্যে এটি ব্যতিক্রম। অন্যান্য সব আইন জনগণের ওপর আরোপ করা হয়। অন্যদিকে তথ্য অধিকার আইন সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর আরোপিত হয়। নাগরিকদের ক্ষমতায়ন, সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, দুর্নীতি হ্রাস এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এ আইনের মূল উদ্দেশ্য। এছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করতঃ জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চয়তা দিতে এ আইন অপরিহার্য।

বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন নামে হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত। কোনো কোনো দেশে এ আইনের নাম তথ্য স্বাধীনতা আইন। যুক্তরাষ্ট্রে এটি আলোকিত আইন নামে পরিচিত। ১৭৬৬ সালে সুইডেনে সর্বপ্রথম এ আইনটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নামে প্রবর্তিত হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তথ্যের স্বাধীনতা একটি মৌলিক মানবাধিকার এবং যেসব অধিকারের প্রতি জাতিসংঘ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তার সবগুলো যাচাইয়ের একটি পরশপাথর”মর্মে উল্লেখ করা হয়। মানবাধিকার সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকে আইনগত অধিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR), ১৯৬৬-এর ১৯(২) অনুযায়ী তথ্য পাওয়া অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭(১) নং ধারা অনুসারে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। সে অনুসারে জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণে তথ্য অধিকার অপরিহার্য। সংবিধানের ৩৯নং ধারা অনুসারে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতা জনগণের মৌলিক অধিকার। তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফসল। এ আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে ৬ জানুয়ারি ২০০৮  একটি কমিশন গঠন করে। তার আগে বিভিন্ন সময় সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিকরা তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়। ২০ অক্টোবর ২০০৮ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ‘তথ্য অধিকার অধ্যাদেশ, ২০০৮’ জারি করা হয়। পরবর্তী সময়ে নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ‘তথ্য অধিকার আইন-২০০৯’ প্রণয়ন করার মাধ্যমে বিশ্ব এ আইন বাস্তবায়নকারী আরও ৮৮টি দেশের তালিকার সঙ্গে যুক্ত হয়।

৮টি অধ্যায় এবং ৩৭টি ধারা নিয়ে তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ প্রণয়ন করা হয়। আইনের ৪নং ধারায় তথ্য অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এই আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে, কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার থাকিবে এবং কোনো নাগরিকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাহাকে তথ্য সরবরাহ করিতে বাধ্য থাকিবে।’ এছাড়া ২(চ) এ তথ্যের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘তথ্য’ অর্থে কোনো কর্তৃপক্ষের গঠন, কাঠামো ও দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত যে কোনো স্মারক, বই, নকশা, মানচিত্র, চুক্তি, তথ্য-উপাত্ত, লগ বহি, আদেশ, বিজ্ঞপ্তি, দলিল, নমুনা, পত্র, প্রতিবেদন, হিসাব বিবরণী, প্রকল্প প্রস্তাব, আলোকচিত্র, অডিও, ভিডিও, অঙ্কিতচিত্র, ফিল্ম, ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় প্রস্তুতকৃত যে কোনো ইনস্ট্রুমেন্ট, যান্ত্রিকভাবে পাঠযোগ্য দলিলাদি এবং ভৌতিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য নির্বিশেষে অন্য যে কোনো তথ্যবহ বস্তু বা উহাদের প্রতিলিপিও ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে:

তবে শর্ত থাকে যে, দাপ্তরিক নোট সিট বা নোট সিটের প্রতিলিপি এর অন্তর্ভুক্ত হবে না।

উল্লিখিত সংজ্ঞা হতে বুঝা যাচ্ছে, একটি দপ্তরের কোনো কোনো বিষয়ে আমাদের তথ্য জানার এবং চাওয়ার অধিকার রয়ছে। আইনের ৬নং ধারার (১) উপধারা মোতাবেক ‘প্রত্যেক কর্তৃপক্ষ উহার গৃহীত সিদ্ধান্ত, কার্যক্রম, কিংবা সম্পাদিত বা প্রস্তাবিত কর্মকাণ্ডের সব তথ্য নাগরিকদের নিকট সহজলভ্য হয়, এইরূপে সূচিবদ্ধ করিয়া প্রকাশ এবং প্রচার করবেন।’ এছাড়া উপধারা ২ থেকে ৮ এ ধারা ১ অনুসারে প্রকাশ ও প্রচারযোগ্য তথ্যগুলো সময়ে সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে স্বতঃপ্রণোধিত হয়ে প্রকাশ বা প্রচারের বিষয়ে বলা হয়েছে।

আইনটির ৭নং ধারা অনুসারে কতিপয় তথ্য প্রকাশ বা প্রদান বাধ্যতামূলক নয়। যে তথ্য প্রকাশে (ক) বাংলাদেশের নিরাপত্তা অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হতে পারে (খ) পররাষ্ট্রনীতির কোনো বিষয় যার দ্বারা বিদেশি রাষ্ট্রের অথবা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা বা আঞ্চলিক কোনো জোট বা সংগঠনের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক ক্ষুণ্ন হতে পারে (গ) কোনো বিদেশি সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত কোনো গোপনীয় তথ্য (ঘ) তৃতীয় পক্ষের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এরূপ বাণিজ্যিক বা ব্যবসায়িক অন্তর্নিহিত গোপনীয়তা বিষয়ক, কপিরাইট বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সম্পর্কিত তথ্য (ঙ) কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা সংস্থাকে লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এরূপ তথ্য, যেমন- [(অ) আয়কর, শুল্ক, ভ্যাট ও আবগারি আইন, বাজেট বা করহার পরিবর্তন সংক্রান্ত কোনো আগাম তথ্য (আ) মুদ্রার বিনিময় ও সুদের হার পরিবর্তনজনিত কোনো আগাম তথ্য (ই) ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা ও তদারকি সংক্রান্ত আগাম তথ্য] (চ) আইনের প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত বা অপরাধ বৃদ্ধি পেতে পারে (ছ) জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে বা বিচারাধীন মামলার সুষ্ঠু বিচারকার্য ব্যাহত হতে পারে (জ) কোনো ব্যক্তির জীবনের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন হতে পারে (ঝ) কোনো ব্যক্তির জীবন বা শারীরিক নিরাপত্তা বিপদাপন্ন হতে পারে (ঞ) আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তার জন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক গোপনে প্রদত্ত কোনো তথ্য (ট) আদালতে বিচারাধীন কোনো বিষয় এবং যা প্রকাশে আদালত বা ট্রাইব্যুনালের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে অথবা যা প্রকাশ আদালত অবমাননার শামিল (ঠ) তদন্তাধীন কোনো বিষয় যা প্রকাশ তদন্ত কাজে বিঘ্ন ঘটাতে পারে এরূপ তথ্য (ড) কোনো অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়া এবং অপরাধীর গ্রেপ্তার ও শাস্তিকে প্রভাবিত করতে পারে (ঢ) আইন অনুসারে কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে (ণ) কৌশলগত ও বাণিজ্যিক কারণে গোপন রাখা বাঞ্ছনীয় এইরূপ কারিগরি বা গবেষণালব্ধ কোনো তথ্য (ত) কোনো ক্রয় কার্যক্রম সম্পূর্ণ হওয়ার আগে বা ওই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সংশ্লিষ্ট ক্রয় বা তা কার্যক্রম সংক্রান্ত কোনো তথ্য (থ) জাতীয় সংসদে বিশেষ অধিকার হানির কারণ হতে পারে (দ) আইন দ্বারা সংরক্ষিত কোনো ব্যক্তির গোপন তথ্য (ধ) মন্ত্রিপরিষদ, উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকে উপস্থাপনীয় সার-সংক্ষেপসহ আনুষঙ্গিক দলিলাদি এবং এরূপ বৈঠকের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত কোনো তথ্য:

তবে শর্ত থাকে যে মন্ত্রিপরিষদ, উপদেষ্টা পরিষদ কর্তৃক কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর অনুরূপ সিদ্ধান্তের কারণ এবং যেসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়েছে তা প্রকাশ করা যাবে :

আরও শর্ত থাকে যে এই ধারার অধীন তথ্য প্রদান স্থগিত রাখবার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তথ্য কমিশনের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করতে হবে।

ধারা ৩২ এ বলা হয়েছে কতিপয় সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য নহে। তফসিলের ব্যাখ্যায় এসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ৮টি গোযেন্দা সংস্থা। ১. জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ২. ডাইরেক্টরেট জেনারেল ফোর্সেস ইনটেলিজেন্স (ডিজিএফআই) ৩. প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা ইউনিটগুলো ৪. ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) ৫. স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) ৬. জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গোয়েন্দা সেল ৭. স্পেশাল ব্রাঞ্চ, বাংলাদেশ পুলিশ ৮. র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) গোয়েন্দা সেল।

এ আইনের এসব বিষয় জানা থাকলে ধারা ৮, ২৪ এবং ২৫ অনুসারে কর্তৃপক্ষ, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং তথ্য কমিশনের কাছে যথাক্রমে আবেদন, আপিল এবং অভিযোগ করে সহজেই একজন মানুষ সহজেই তার তথ্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারেন। অধিকার-অনধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতাই ওই আইনের ফলপ্রসূ বাস্তবায়নের মূল অন্তরায়। অধিকার-অনধিকারগুলো যথাযথভাবে জানা থাকলে বিড়ম্বনা কাটিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ আশীর্বাদস্বরূপ।