Print Date & Time : 27 June 2025 Friday 3:41 am

তথ্য গোপন করে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে এনার্জিপ্যাক

রহমত রহমান: এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড বিদ্যুৎ খাতে পরিচিত নাম। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশের বিদ্যুৎ খাতে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করে বিপুল পরিমাণ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নামমাত্র ভ্যাট দিলেও অফিস ভাড়া ও অফিসের কেনাকাটায় কোনো ভ্যাট দেয়নি।
সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিরীক্ষায় ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি উঠে এসেছে। ফাঁকি দেওয়া ভ্যাট পরিশোধে প্রতিষ্ঠানটিকে দাবিনামা জারি করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন, ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশনে কাজ করে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি জেনারেটর ও জেনারেটর যন্ত্রপাতি আমদানিকারক হিসেবে পরিচিত। প্রতিষ্ঠানটি লুব্রিক্যান্ট ওয়েল, স্পেয়ার পার্টস ও এনার্জি সেভিং ল্যাম্প বাজারজাত করে। সাব-স্টেশন যন্ত্রপাতি, ট্রান্সফরমার, সুইচ, গিয়ার, ডিসকানেক্টিং সুইচ তৈরি করে। এনার্জিপ্যাক এনবিআরের আওতাধীন ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি তথ্য গোপনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের নির্দেশে ভ্যাট দক্ষিণ অঞ্চল এনার্জিপ্যাকের ফাঁকি উদ্ঘাটনের উদ্যোগ নেয়। প্রতিষ্ঠানের দাখিলপত্র নিরীক্ষা করা হয়। নিরীক্ষায় বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি উঠে আসে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বিক্রয়োত্তর সেবা (সার্ভিস) প্রদান করে আসছে। সেবার বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন মেয়াদে দেড় শতাংশ, সাড়ে চার শতাংশ ও সাড়ে পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট পরিশোধ করা আসছে। কিন্তু এনবিআরের এসআরও এবং প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাট নিবন্ধনপত্র অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি ইনডেনটিং সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সেবার (সার্ভিসিং) ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। সেবা অনুযায়ী পণ্যের বিনিময়ে করযোগ্য পণ্য মেরামত বা সার্ভিসিংয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে ১৫ শতাংশ হারে না দিয়ে বিভিন্ন হারে দিয়ে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এনার্জিপ্যাক ২০০৮ সালে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান করেছে। প্রতিষ্ঠানটি দেড় শতাংশ, পাঁচ দশমিক ২৪ শতাংশ ও সাড়ে চার শতাংশ হারে প্রায় ৯ লাখ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেছে। যদিও সার্ভিসিংয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ভ্যাট ১৫ শতাংশ। ১৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য ভ্যাট প্রায় সাড়ে ৫১ লাখ টাকা। তথ্য গোপন করে প্রতিষ্ঠানটি এক বছরে প্রায় ৪৩ লাখ টাকা ফাঁকি দিয়েছে।
একইভাবে ২০০৯ সালে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ, ২০১০ সালে প্রায় ১৫ লাখ, ২০১১ সালে প্রায় ২৯ লাখ, ২০১২ সালে প্রায় ৫৬ লাখ এবং ২০১৩ সালে প্রায় ৬১ লাখ টাকা ফাঁকি দিয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে প্রায় সাড়ে ২২ কোটি টাকার সার্ভিসিং সেবার বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি আড়াই কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে বলে নিরীক্ষায় উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এনার্জিপ্যাক ২০১২-১৩ অর্থবছরে বার্ষিক প্রতিবেদনে অন্যান্য আয় হিসেবে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা দেখিয়েছে। কিন্তু ভ্যাট রিটার্নে এ টাকার উৎস দেখায়নি। এ বিষয়ে কোনো তথ্যও দিতে পারেনি। ভ্যাট ফাঁকি দিতে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রের তথ্য গোপনের মাধ্যমে পণ্য বিক্রির আয়কে অন্যান্য আয় হিসেবে দেখিয়েছে। পণ্য বিক্রির এ আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রায় ৯৪ লাখ টাকাÑযা প্রতিষ্ঠানটি ফাঁকি দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী লিমিটেড কোম্পানির কেনাকাটা বা ব্যয়ের ওপর উৎসে ভ্যাট প্রযোজ্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠান ব্যয়ের ওপর কোনো ভ্যাট কর্তন না করে ফাঁকি দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রায় ১৬ লাখ টাকা পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে। একইভাবে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে প্রায় ২০ লাখ, ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ২৮ লাখ, ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় দেড় কোটি, ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রায় ৭৪ লাখ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রায় দেড় কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে। সুদসহ মোট ফাঁকি প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অফিস ভাড়ার ওপর কোনো ভ্যাট পরিশোধ করেনি। এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী স্থান-স্থাপনা ভাড়ার ওপর ২০১০ সাল পর্যন্ত ১৫ শতাংশ ও ২০১০-এর পর থেকে ৯ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। অফিস ভাড়ার ওপর ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৪৬ লাখ, ২০১০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩৭ লাখ, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩৭ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রায় ৯৪ লাখ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রায় আড়াই কোটি টাকাসহ প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। সুদসহ মোট ফাঁকি প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে সুদসহ এনার্জি প্যাকের মোট ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ প্রায় ১৬ কোটি টাকা। এ ভ্যাট পরিশোধে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিকে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়। পরে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে কর্মকর্তারা অংশ নিয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তবে ব্যাখ্যায় ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি স্বীকার করে নেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি চূড়ান্ত ভ্যাট দক্ষিণ কমিশনার কাজী মোস্তাফিজুর রহমানের সই করা দাবিনামা জারি করা হয়। ভ্যাট আইন অনুযায়ী চূড়ান্ত দাবিনামা জারির নির্দিষ্ট সময় পর ভ্যাট পরিশোধ না করলে প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার বিধান রয়েছে।
এ বিষয়ে এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশীদ শেয়ার বিজকে বলেন, প্রত্যেকটি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে আমাদের এখন পর্যন্ত কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি। এ রকম দাবিনামা এনবিআরের থাকতে পারে। দাবিনামা তো স্বাভাবিক। এখন আমরা আমাদের যুক্তি নিশ্চয়ই দাঁড় করাব যে, কেন আমরা তাদের যুক্তির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করছি না। যুক্তির পর আমাদের ভ্যাট দিতে হলে দেব।