নিজস্ব প্রতিবেদক: ক্ষুদ্রঋণের চেয়ে বৃহৎ অঙ্কের ঋণখেলাপি বেশি। দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার প্রধান উপায় আদায় বেশি করা। এমন মতামত দিয়ে আসছেন বিশ্লেষকরা। এজন্য খেলাপি নিয়ন্ত্রণে বড় অঙ্কের ঋণ তদারকি শুরু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
আগামী মাস থেকে বড় অঙ্কের ঋণ-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহে নামছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি সব ব্যাংকে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্দিষ্ট ছকে প্রতিমাসের ১০ তারিখে সফটওয়্যারের পাশাপাশি কাগুজে প্রতিবেদন দিতে হবে আগের মাসের। অর্থাৎ আগামী ১০ এপ্রিলের মধ্যে চলতি মার্চের তথ্য দিতে হবে।
জানা গেছে, শুধু ঋণের পরিমাণ নয়, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও কিছু তথ্য দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকের মূলধন, ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ক্রেডিট রিস্ক গাইডলাইন, পরিচালনা পর্ষদের প্রতিবেদন, ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ঋণ, একক গ্রাহকসীমার পরিমাণ, বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ, খেলাপি বা আদায় না হওয়ার তথ্য প্রভৃতি।
এছাড়া খাতভিত্তিক বিতরণকৃত ঋণের পুরো চিত্র দিতে হবে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ‘পুরোনো দুটি ছক বাতিল করে নতুন বিস্তারিত ছক দেয়া হয়েছে। এতে ব্যাংকের ঋণ তথ্যের একটি সারমর্ম পাওয়া যাবে। এককথায় বলতে গেলে, মাসভিত্তিক প্রতিবেদন দেখলেই বোঝা যাবে কোনো ব্যাংকের ঋণ বিতরণের প্রকৃত চিত্র। ব্যাংকগুলোর বৃহৎ ঋণেই অনিয়ম বেশি হয়। এটি তদারকি করলে শৃঙ্খলায় চলে আসবে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ খাতটি, যার প্রভাব পড়বে পুরো ব্যাংক খাতে।’
তথ্য ঋণগ্রহীতা সম্পর্কে একটি সারমর্ম প্রতিবেদনও দিতে হবে। এতে ঋণগ্রহীতার ব্যবসার ধরন বা প্রকৃতি, গ্রহীতার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, তার ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা, ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ, আদায় পরিস্থিতি, মূলধন, কী উদ্দেশ্যে ঋণ দেয়া হচ্ছে, খেলাপি হওয়ার তথ্য, পুনঃতফসিল হয়েছে কি না এমন তথ্য দিতে হবে প্রতিবেদনে।
খেলাপি কমিয়ে আনতে বৃহৎ ঋণ তদারকিতে সব ব্যাংকে পৃথক সেল গঠন করার নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সেল ব্যাংকের বৃহৎ ঋণ বিতরণ তদারকি ও আদায় কার্যক্রম দেখভাল করবে। সেই সেলের কার্যক্রম তদারকি করতে
বাংলাদেশ ব্যাংক এমন উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে ব্যাংকগুলোর তৎপরতা বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
খেলাপি নিয়ন্ত্রণ ও ঋণ বিতরণে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নির্দেশনা দিয়েছিল। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে বড় ঋণ বিতরণে বেশ কয়েকটি শর্ত পরিপালন করতে দেয়া হয়। ব্যাংকগুলোর সক্ষমতার ওপর ভর করে বৃহৎ ঋণে কিছুটা লাগাম টানা হয়। সর্বশেষ হালনাগাদ করা নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তিন শতাংশের বেশি ও পাঁচ শতাংশের কম থাকলে ওই ব্যাংক তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪৬ শতাংশ পরিমাণ বৃহৎ ঋণ দিতে পারবে। এর আগের সিদ্ধান্ত ছিল মোট ঋণের পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ থাকলে ৫৬ শতাংশ বড় অঙ্কের ঋণ দিতে পারত। এভাবে ব্যাংকগুলোর বৃহৎ ঋণ বিতরণের ক্ষমতা ১০ শতাংশ কমানো হয়।
আবার খেলাপি ঋণ পাঁচ শতাংশের বেশি, কিন্তু ১০ শতাংশের কম হলে মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪২ শতাংশ বড় অঙ্কের ঋণ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো, যেখানে আগে এ ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের ঋণ দেয়া যেত ৫২ শতাংশ। খেলাপি ১০ শতাংশের বেশি, কিন্তু ১৫ শতাংশের কম হলে সর্বোচ্চ বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃহৎ ঋণ দিতে পারবে, যা আগে ছিল ৪৮ শতাংশ।
এছাড়া ১৫ শতাংশের বেশি, কিন্তু ২০ শতাংশের কম খেলাপি হলে মোট ঋণের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৪ শতাংশ বৃহৎ গ্রাহককে দিতে পারবে ব্যাংক। এ ছাড়া আগের নিয়মে কোনো ব্যাংকের মূলধনের ২০ শতাংশের পরিবর্তে এখন থেকে বড় অঙ্কের ঋণ দেয়া যাবে ১০ শতাংশ। একক কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপকে প্রদত্ত ঋণসুবিধা কোনোভাবে ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না বলেও নির্দেশনায় উল্লেখ রয়েছে, যা আগে ছিল ৩৫ শতাংশ। এভাবে বৃহৎ অঙ্কের ঋণ বিতরণে লাগাম টেনে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১৪ সালের পর গত জানুয়ারিতে এমন সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সেই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন দেখতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সূত্র জানিয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতকে সুসংহত রাখতে নীতিমালায় বাস্তবায়নের পথে হাঁটতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গত দুই বছর নীতিমালা শিথিল করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থনীতি সচল রাখতে গিয়ে বৃহৎ আকারের ব্যবসায়ীদের বেশ কয়েকটি সুবিধা ও ছাড় দেয়া হয়েছিল। বিশেষ করে ঋণ আদায় ও খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে। তখন বলা হয়েছিল, কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি করা যাবে না। একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তি ধরে রাখতে ঢালাওভাবে প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় গত বছর লক্ষাধিক কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিলতাকে দুর্বল ভেবে কোনো কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রণোদনার ঋণ অপব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে।
এখন সেই ঋণের প্রকৃত অবস্থা জানতে উদ্যোগ নিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ পরিসংখ্যানমতে, গত ডিসেম্বর শেষে এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে, যা মোট ঋণের আট শতাংশ। খেলাপি হওয়া ঋণের মধ্যে ৫০ কোটি টাকাই বৃহৎ ঋণ। ব্যাংক খাতে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ১৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। এসব খেলাপির মধ্যে ৯০ হাজার কোটি টাকা আদায়-অযোগ্য ঋণে পরিণত হয়েছে। এর বাইরে আদায়-অযোগ্য আরও প্রায় অর্ধ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে, যা অবলোপন ঋণ হিসেবে ব্যাংকের খাতায় রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ এক হাজার ৭৯৭ কোটি ২৬ লাখ টাকায়।