ইসরাফিল আলম রাফিল: মানসিক বিকাশ একটি চলমান প্রক্রিয়া। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষের মানসিক বিকাশ স্তরে স্তরে বিভক্ত। মানসিক বিকাশ যখন বাধাগ্রস্ত হয়, তখন সৃষ্টি হয় মানসিক জটিলতা। আর সেই মানসিক বিভিন্ন জটিলতা থেকে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার শুরু। পারিবারিক অশান্তি, তরুণদের পড়াশোনার চাপ, শিশুদের স্কুলে শাস্তি পাওয়ার ভয় ও বৈবাহিক সম্পর্কের জটিলতা প্রভৃতি কারণ মানসিকভাবে আমাদের বিপর্যস্ত করে তোলে। দেশে মানসিক স্বাস্থ্য নীতিমালা রয়েছে। উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মনকে ভালো রাখতে নিয়মিত ব্যায়ামের চর্চা এবং পুষ্টিমানসম্পন্ন ও সুষম খাবার মস্তিষ্ককে সুরক্ষা দিতে পারে। তাই মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে।
মানসিক রোগ সচরাচর তরুণদের মাঝে বেশি লক্ষ করা যায়। কিন্তু তরুণরা এগুলো ঠিকমতো বুঝতে পারে না। আমরা মানসিক সমস্যার বিভিন্ন নাম দিয়ে থাকি; কেউ বলে থাকে বয়সের দোষ, আবার ভূতে ধরাসহ বিভিন্ন কুসংস্কার এখনও রয়েছে। এর ফলে সমস্যা দীর্ঘায়িত হতে থাকে। অবহেলার কারণে সমস্যা গুরুতর হতে থাকে। বর্তমান সময়ে মানসিক সমস্যা একটা রোগ। এ বিষয়ে শিক্ষিত সমাজ অনেকটাই অবগত হয়েছে, যার ফলে এখন অনেকে এই সমস্যা সমাধানে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। গবেষকদের মতে, মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে মূলত তিনটি বিষয় জড়িতÑ১. বংশগত, ২. মস্তিষ্কের রাসায়নিক পরিবর্তন, ৩. পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব। এই তিনটি বিষয়ের মাঝে বংশগত ও সামাজিক প্রভাবের কারণে মানসিক সমস্যায় আমরা প্রতিনিয়ত বেশি ভুগে থাকি। এছাড়া মানসিক রোগের মেডিসিন প্রয়োগ করা হয় মূলত ব্রেন ইমাজিং এবং টপোগ্রাফি পরীক্ষা করে। এই পরীক্ষায় রাসায়নিক পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশে ভয়াবহ হারে বাড়ছে মানসিক রোগী। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৩৪ জনই মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। সময়ের সঙ্গে এ হার বেড়েই চলেছে। অবাক করার বিষয়, মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি। প্রতি এক লাখ মানুষে ছয়জন আত্মহত্যা করছে মানসিক সমস্যার কারণে।
বেকারত্ব, হতাশা, অস্থিরতা, ব্যক্তিজীবনের অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, নানামুখী চাপ, অপ্রাপ্তি, লোভ ও বিচারহীনতা তরুণদের মানসিক রোগীতে পরিণত করছে। বর্তমানে তরুণদের বিরাট অংশ অনলাইন জগতে খুব পরিচিত। মোবাইল ও ল্যাপটপ দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন গেমে অনেকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এমনকি ছোট শিশুদের খাওয়ানোর সময় অভিভাবকরা ভিডিও গেম খেলতে বা কার্টুন দেখতে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। এই কমবয়সী শিশুরা ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু অভিভাবকরা বুঝতে পেরেও এ উপায় অবলম্বন করছেন। কমবয়সী শিশুদের মানসিক বিকাশ ঘটবে হই-হুল্লোড় করে খেলার মাঠে, কিন্তু আধুনিক যুগে বিপরীত হচ্ছে। এর ফলে শিশুরাও মানসিক সমস্যায় ভুগছে।
কভিডের প্রকোপে সারাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। এসময় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা একঘেয়ে সময় কাটিয়েছে। দীর্ঘ বন্ধ শেষে আবার শিক্ষার্থীরা সশরীরে ক্লাসে আসছে এবং পরীক্ষা দিচ্ছে। অনেকদিন পর স্কুল-কলেজ খোলার পর শিক্ষার্থীদের চাপ এড়াতে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে, যা প্রশংসনীয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ পাচ্ছে না। দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে দুটা সেমিস্টারে হয়ে থাকে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে শুধু ক্লাস করেছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর শুধু পরীক্ষা দিয়েই যাচ্ছে। একটি সেমিস্টার শেষ হওয়ার পর আরেকটা সেমিস্টার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এখানে কোনো সিলেবাস কমানো হচ্ছে না। পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমন সিদ্ধান্তে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যে প্রভাব পড়তে পারে, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিবেচনা করা উঠিত ছিল।
১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ অক্টোবর ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’ পালিত হচ্ছে। নানা আয়োজনে আমাদের দেশেও দিনটি পালিত হয়। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা কভিডকালে আমরা অনেকটা বুঝতে পারছি। তরুণ থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষের দোরগোড়ায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারের বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার দূর করতে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য আইন, নীতিমালা ও কৌশলপত্র বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি, আন্তঃমন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রাখা জরুরি। প্রান্তিক জনগণ, প্রবীণ ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন।
বিশ্বে ১০০ কোটি মানুষ মানসিক রোগে ভুগছে, যার ৫০ শতাংশই শুরু হয় ১৪ বছর থেকে। সারাবিশ্বে মৃত্যুর এক দশমিক তিন শতাংশ হলো আত্মহত্যা, যেখানে তরুণদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হলো মানসিক সমস্যা। তাই মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে আমাদের সবাইকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা হেল্পলাইন এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে অবগত করতে হবে।
স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ঠিক করে মানসিক স্বাস্থ্যের কৌশলগত পরিকল্পনায় সরকারকে নজর দিতে হবে। আমাদের দেশে আত্মহত্যার ঘটনা ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেশি। মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় দক্ষ সেবাদাতা বাড়াতে মাঠকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। প্রতিটি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ দিলে সব পেশার মানুষের কাছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। তাই পরিবার ও অভিভাবকদের এ বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান থাকাও প্রয়োজন, যাতে করে তাদের সন্তানেরা মানসিক সমস্যায় ভুগলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে আরও বেশি মনোযোগী হতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সরকার। সুখী, সমৃদ্ধ ও বৈষম্যহীন মানবিক বিশ্ব গঠনে শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দেয়া প্রয়োজন; তাহলেই কেবল আত্মহত্যাসহ অন্যান্য মানসিক ব্যাধির ফলে সংঘটিত মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসবে।
শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়