মোহাম্মদ অংকন : আমরা বর্তমান তরুণ প্রজন্ম ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, দেখার কথাও নয়। তবুও আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট। আমরা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা শুনেছি বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি কিংবা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তাৎপর্য, প্রেক্ষাপট, কেন মুক্তিযুদ্ধ হলো এসব নিয়ে লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতা পড়েছি পাঠ্যবইসহ পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন লেখকদের বই থেকে। মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা নিয়ে নির্মিত তথ্যবহুল চলচ্চিত্র, নাটক ও প্রামাণ্যচিত্র আমাদের উপলব্ধি করিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো কেমন ছিল, বাঙালি জাতি মুক্তির জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছে। পরাধীনতার বেড়াজাল থেকে মুক্তির জন্য মানুষ বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে; নারীরা ইজ্জত সমর্পণ করেছে। এসব এখন শুধু উপলব্ধির বিষয়। তাই আমাদের তরুণ প্রজন্মেরমুক্তিযুদ্ধকে আত্মীকরণের প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা।
প্রতি বছর যেদিন ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস আসে, আমরা উপলব্ধি করি, ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশকে পাক হানাদার মুক্ত করতে বাংলার আপামর জনগণ দৃঢ় মনোবল নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের ছিল না সুসজ্জিত গাড়িবহর, ছিল না শক্তিশালী অস্ত্র। কোন বলে তারা যুদ্ধক্ষেত্রকে ‘কোমল বাগান’ ভেবে জীবনমরণ বাজি ধরল এসব তরুণ প্রজন্মকে নিদারুণ ভাবায়। আবার ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস এলে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল। তরুণ প্রজন্ম আবারও আবেগপ্রবণ হয়ে যায়, বাংলার মুক্তিকামী মানুষগুলোর সংগ্রামের প্রগাঢ়তার বিষয়বস্তু উপলব্ধি করে। যেখানে পাকস্তানিরা বোমা-বারুদ জ্বালিয়েছে, সেক্ষেত্রে বাঙালিরা কীভাবে সেসব মোকাবিলা করেছে? নিশ্চিত দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা সব প্রতিকূলতাকে মোকাবিলার প্রতি উৎসাহ জুগিয়েছে।
দেশপ্রেমের এমন অবিস্মরণীয় ঘটনাপ্রবাহ তরুণ প্রজন্মকে অবশ্যই অনেক কিছু শিক্ষা দেয়। যখন নানা উৎসাহ-উদ্দীপনা আর আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ এই দিবসগুলো পালন করতে দেখি, তখনই গভীর এক ভাবনার সাগরে হারিয়ে যাই এই ভেবে যে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার মর্যাদা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু এই দিবসগুলোর তাৎপর্য এখন কতটা ফলদায়ক, তা নিয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের নানা প্রশ্ন রয়েছে।
তরুণ প্রজন্মের সোজাসাপটা প্রশ্ন আমরা যদি ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে থাকি, তবে আজকের বাংলাদেশ এত পশ্চাৎপদ কেন? স্বাধীনতা অর্জনের এতটা বছর পরও কি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি? এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশ আর পূর্বের অবস্থানে নেই। সার্বিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তবে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে দেশ এখনও চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি। শিক্ষা খাতে অনিয়ম, চিকিৎসা খাতে নৈরাজ্য, খাদ্যে ভেজাল, পরিবহন খাতে স্বেচ্ছাচরিতা, নারীদের অনিরাপত্তা, পরিবেশ বিপর্যয়, চাঁদাবাজিসহ বেশ কিছু বিষয় যেন আমাদের পরাধীনতার স্বাদ উপলব্ধি করতে বাধ্য করছে। এসব দৃশ্যমান অস্থিরতা প্রমাণ দেয় দেশ যেন এক অনিয়মের বেড়াজালে বন্দি।
স্বাধীন দেশে কোনো যুবককে চাকরি পেতে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে। আবার ক্ষমতার বলে অনেকের চাকরি, পদ-পদবি সবই মিলছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেমন আর্থিক দীনতায় চাকরির বাজারে পা রাখতে পারছে না, তেমনি কোটা পদ্ধতি তাদের জাপটে ধরছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব বাঙালি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তখন কি তাদের ভাবনা এমন ছিল যে, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করে দিই, আমাদের ছেলেমেয়েরা মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে সরকারি চাকরিবাকরি করে আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করবে! নাকি চেয়েঠিছলেন একটি স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে, যেখানে কোনো বৈষম্য, ভেদাভেদ, হিংসা ও অপরাজনীতি থাকবে না। বর্তমান প্রজন্মকে এসব লজ্জাজনক বিষয় চরমভাবে ভাবিয়ে তোলে। স্বাধীনতার তাৎপর্য আজ কোথায় গিয়ে সমাসীন হচ্ছে, তা তরুণ প্রজন্ম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
আমাদের তরুণ প্রজন্মের ভাবনায় প্রগাঢ়ভাবে ধরা দেয়বাংলাদেশের স্বাধীনতা কি আজ ব্যক্তিবিশেষের হাতে বন্দি? রাজনৈতিক ভূক্ষেপে স্বাধীনতা কি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে? সত্যই কতিপয় ক্ষমতাসীন বাংলাদেশের জনগণকে রেখে স্বাধীনতা নিয়ে বরাই করে, যেন স্বাধীনতা কোনো ব্যক্তিবিশেষের সুবিধাভোগের জন্য অর্জিত হয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক আচরণের কারণে স্বাধীনতার মানমর্যাদা সর্বদা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। স্বাধীনতা অর্জনের আসল উদ্দেশ্য সর্বত্র ব্যাহত হচ্ছে। ১৯৭১ সালে শুধু একশ্রেণির মানুষের সুবিধা ভোগের জন্য স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। সে সময় দেশমাতৃকার প্রবল টানে দল, মত নির্বিশেষে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। উদ্দেশ্য ছিল, খাই বা না খাই, আমরা সব বাঙালি একই ছায়াতলে থাকব। এমন ধ্রুব সত্য বিবেচনায় বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব বাঙালির মুক্তির জন্য দ্ব্যর্থ কণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যার কাছে যা আছে তা-ই নিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ তিনি এমন কিছু বলেননি যে, যারা আমার দল কর, তারাই শুধু যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ো। সত্যই, আমরা তরুণ প্রজন্ম ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছি, বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক, যার কাছে মানুষের বাঁচার অধিকার ছিল মোক্ষম। সবাইকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা ছিল একচ্ছত্র দেশপ্রেমের নমুনা। তাঁর দৃষ্টিতে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ছিলেন তাঁর ভাই, আপনজন।
বর্তমান সময়ে এসে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শকে অনুসরণের নাম করে একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতারা অপরিমিত ফায়দা লুটছে, হীন স্বার্থকে হাসিল করছে। বাংলাদেশকে তাদের দখলদারিত্বের মুঠোয় এনে যেন আবার পরাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা ব্যতিব্যস্ত। তবে এ-জাতীয় কুচক্রীমহলকে নির্ণয় করা কষ্টসাধ্য। ‘দেশের খেয়ে দশের মেরে’ দিয়ে তারা গলায় ঠিকই স্বাধীনতার মর্মবাণী প্রচার করে চলেছে। অথচ গোপনে এমন কোনো রাষ্ট্রদ্রোহিমূলক কাজ নেই যা তারা করছে না। যাইহোক, কী কী রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ করছে, তা মুখে বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনতার প্রকৃত মান বজায় রাখতে এসব অপর্কীতি ও রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজ বন্ধ করা আবশ্যক এটাই তরুণ প্র প্রজন্মের দাবি।
আমরা বর্তমান তরুণ প্রজন্ম এটি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম যে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বাধীনতার বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস না করলে দেশদ্রোহী হতে হবে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু বর্তমান দেশীয় প্রেক্ষাপট আমাদের নানা ধরনের দুশ্চিন্তায় পর্যবশিত করে এই ভাবিয়ে যে, দেশের কতজন ব্যক্তি স্বাধীনতাকে বুকে লালন করে রয়েছে? রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিকে তাকালে তার কিঞ্চিৎ হলেও নমুনা পাওয়া যায়। তারা কী করছেন, স্বাধীনতাকে পুঁজি করে রাজনীতির খাতায় নাম লিখিয়ে দুর্নীতিতে শীর্ষ হচ্ছেন। এতে কি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বজায় থাকছে? স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দ্বারা সম্পাদিত ঘৃণ্য কাজগুলো যেন তরুণ প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার স্বরূপ নির্ণয় করার বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাদের মনে প্রশ্ন স্বাধীনতাকে পুঁজি করে রাজত্ব? মুক্তিযুদ্ধকে সম্বল করে কেন লুটতরাজ, রাহাজানি?
বর্তমানে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে বিষয়টি তরুণ প্রজন্মের চোখে বাধছে, তা হলো মুক্তিযুদ্ধের সনদকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হাসিল করা। এই সনদের অপব্যবহার এত দূর অবধি চলে গেছে যে এর জন্য কিছু লোক মরিয়া। রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তিযুদ্ধ না করেও ‘মুক্তিযোদ্ধা সনদ’ অর্জন করছে। শুধু কি তা-ই, এসব অমুক্তিযোদ্ধারাই স্বাধীনতা দিবসে সরকার কর্তৃক বিশেষ বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত হচ্ছে, পদক প্রাপ্ত হচ্ছে, মাসে মাসে ভাতা পাচ্ছে। এতে আমাদের স্বাধীনতার মান বাড়ছে না কমছে, নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম। সেইসঙ্গে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নির্ণয় করে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য সরকারকে দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান রইল।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের দেশটা ক্রমেই উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে বিশেষভাবে সাফল্যমণ্ডিত। আমরা আকাশে আজ নিজস্ব^ স্যাটেলাইট নিক্ষেপ করেছি। আরও নানা ধরনের উন্নয়নযজ্ঞে আমরা আনন্দিত। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উন্নয়ন গতি আরও বেগবান হবে। তবে বর্তমান সরকারকে দুটি বিশেষ বিষয়ের ওপর এখনই সুনজর প্রদান করতে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বস্বরূপ আমি আবেদন করছি। প্রথমত, যে কোনো মূল্যে স্বাধীনতার মর্যাদাকে বজায় রাখতে হবে। কবি বলেছেন, ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন।’ তাই এ কঠিন কাজের দিকে আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বর্তমান তরুণ প্রজন্মের দিকে নজর দিতে হবে। আমরা দেখছি, তরুণদের কর্মমুখী নানা কাজে লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। কিন্তু তা কতটা সাফল্যমণ্ডিত বা সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিংবা এতে শুধু একশ্রেণির তরুণ লাভবান হচ্ছে কি না, তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। অনেক তরুণের পরিবার ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে আংশগ্রহণ করতে পারেনি, তা-ই বলে সেই তরুণ কি অপরাধ করেছে? কেন একাত্তরে পরিবারের অপরাগতা নিজে বহন করবে? এটা কি তার প্রতি বৈষম্য নয়? বর্তমান তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা কারও প্রতি বৈষম্য নয়। স্বাধীনতার প্রকৃত লক্ষ্য যদি বৈষম্য, একচ্ছত্র অধিকারতন্ত্র হতো, তবে অনেক আগেই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হতো। তবে স্বাধীনতা বিলুপ্ত না হলেও বাংলাদেশে স্বাধীনতার চরম অপব্যবহার চলছে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি সুন্দর দেশ গড়তে স্বাধীনতার অপব্যবহার রুখতেই হবে। স্বাধীনতার মান বজায় রাখতে হবেই। স্বাধীনতাকে হরণ করে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার হতে দেওয়া যাবে না। তরুণ প্রজন্মকে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানতে দিতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব দিতে হবে। কেননা, পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হতে পারে একমাত্র তরুণ প্রজন্ম। স্বাধীনতা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হোক, সে প্রত্যাশা করছি।
ফ্রিল্যান্স লেখক
md.angkon12@gmail.com