তরুণ প্রজš§ গড়বে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ

ইমদাদ ইসলাম: বাংলাদেশে হরিজন বলতে আমরা সাধারণত ব্রিটিশ আমলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পয়োনিষ্কাশন, চা-বাগান, রেলের কাজসহ অন্যান্য কাজের জন্য ভারতের নানা অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা দরিদ্র ও দলিত জনগোষ্ঠীকে বুঝি। এর পর থেকে কয়েক প্রজš§ ধরে এই ভূখণ্ডে বসবাস করছে তারা। এদেশে হরিজনদের প্রধান পেশা মূলত সুইপারের কাজ। সরকার সব শ্রেণির মানুষের জন্য এ কাজটির সুযোগ করে দেয়ায় এই পেশাও হারাতে বসেছে হরিজনরা। বাংলাদেশে পরিচ্ছন্নতা-সংক্রান্ত পেশায় নিয়োজিত বাঁশফোড়, হেলা, লালবেগী, ডোমার, রাউত, হাঁড়ি, ডোম (মাঘাইয়া) ও বাল্মীকিÑএ আট জাতের জনগোষ্ঠীকে হরিজন বলা হয়। হরিজনদের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মহাত্মা গান্ধী ১৯৩৩ সালে সমাজে অস্পৃশ্য বলে বিবেচনা করা লোকদের হরিজন নামে নামকরণ করেন পুনা চুক্তির পর। হরিজনের অর্থ হচ্ছে হরি বা ভগবানের লোক।

ব্রিটিশ আমলে ভারতের তেলেগু থেকে আসা হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন প্রায় ৪০০ বছর ধরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বংশালের আগাসাদেক রোডে মিরন জল্লার কলোনিতে বসবাস করছে। এখানে বর্তমানে পাঁচ শতাধিক পরিবার রয়েছে। তারা বর্তমানে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা-সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত। এখানে বসবাস করা সবার বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা এই কলোনিতে। ভূমিহীন ও নিজস্ব বসতভিটাহীন হরিজন সম্প্রদায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় সরকার প্রদত্ত জমি, রেলস্টেশনসহ সরকারি খাসজমিতে বসবাস করে আসছে প্রায় ৪০০ বছর ধরে। উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের নামে পুনর্বাসন ছাড়া তাদের মাঝেমধ্যেই উচ্ছেদ করা হয়, যার প্রত্যক্ষ উদাহরণ রাজধানীর হরিজন সম্প্রদায়ের বসতি মিরন জল্লা কলোনিতে উচ্ছেদ অভিযান। হরিজনরা এত বছর ধরে একই জায়গায় থাকার কারণে সেখানে গড়ে উঠেছে তাদের আলাদা এক সংস্কৃতি, ভিন্ন এক সভ্যতা ও জগৎ।

এদেশে যুগের পর যুগ শহরকে পরিচ্ছন্ন ও তিলোত্তমা রাখতে যারা কাজ করছে, ওই হরিজনদের এই শহরে নেই কোনো স্থায়ী আবাসস্থল। যারা কয়েকশ বছর ধরে সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে চকচকে শহর বানাচ্ছে, তারাই এখন বড্ড বেমানান এ শহরে।
একই মানুষ, একই রক্ত, একই স্থানে বেড়ে ওঠা, একই দেশের নাগরিক, একই রাস্তায় হাঁটাচলাÑতবুও ভেদাভেদ তাদের নিয়ে। ঘরে-ঘরে, পরিবারে-পরিবারে ও সমাজে-সমাজে বিরাজমান নানা বৈষম্যের মাঝেও আলাদা করে চিহ্নিত করা হয় তাদের। গোটা শহরকে যারা সাফ ও সুন্দর করে রাখেন, তারাই কিনা এখন সবচেয়ে নোংরা-অপরিষ্কার, অসুন্দর ও অপবিত্র! যুগের পর যুগ ধরে বাস করা এসব মানুষের ভোটার আইডি থেকে শুরু করে স্থায়ী ঠিকানার সব কাগজ জুটলেও জোটেনি কোনো বাস্তবিক আবাসনের ঠিকানা।

সংবিধানই হওয়ার কথা ছিল এসব মানুষের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় রক্ষাকবচ, কিন্তু সেখানেও আছে হতাশার গল্প। হরিজনরা অর্থনৈতিক দুর্দশা, সামাজিক ও মানবিক মর্যাদার দিকসহ নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে যুগের পর যুগ। পেশা ও বংশপরিচয়ের কারণে দলিত মানুষেরা বৈষম্যের শিকার হন। হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকেরা তাদের হাত দিয়ে স্পর্শ করতে চান না। মৌলিক অধিকার থেকে শুরু করে ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি করানো, স্কুল ড্রেস পরা থাকলেও কাগজে নাস্তা দেয়া, ময়লা পাত্রে পানি দেয়া, কিংবা হোটেলের বাইরে বসে খেতে দেয়া, ক্লাসের পেছনের দিকের বেঞ্চে তাদের বসতে দেয়াÑএমন সব মধ্যযুগীয় ঘটনার মুখোমুখি তাদের প্রতিদিনই হতে হয়। রোহিঙ্গা কিংবা বিহারিদের এদেশে বিশেষ সুবিধায় পুনর্বাসন করা হলেও ভাগ্যদেবী সহায় হন না এদের কিছুতেই। শত শত বছর ধরে এমনই নির্মোহ বঞ্চনার শিকার হচ্ছে তারা। দুবার মানচিত্র বদলেছে, দেশভাগ হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, নতুন সংবিধান হয়েছে, তবুও তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় না।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ভূমি ও শিক্ষাÑএ দুটি অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই দুটি অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে জীবিকা ও সম্মানের মতো অন্যান্য অধিকার তাদের পক্ষে অর্জন করা সহজ হয়ে যায়। কিছু মানুষ এতটাই প্রান্তিক হয়ে গেছেন যে তারা শ্মশানঘাট পর্যন্ত রক্ষা করতে পারছেন না। সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে। তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানেন না। আবার কোথায় গেলে তারা সেবা পাবেন, তাও জানেন না। পাশাপাশি সেবা প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে প্রান্তিক মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করবে, তাদের যে আলাদা কিছু দেবে, সেই জায়গায়গুলো চিহ্নিত করতে পারে না। তাই সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজসহ গণমাধ্যমের ভূমিকা রাখতে হবে।
দলিত, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর সঠিক পরিসংখ্যান দরকার। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিয়ে কোনো একটা পরিকল্পনা করতে গেলে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হয় প্রকৃত পরিসংখ্যান না থাকায়। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনেকে বাংলায় লিখতে ও পড়তে পারলেও তাদের মাতৃভাষায় লিখতে ও পড়তে পারে না। দলিত মানুষদের মধ্যেও কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য করে এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু বেশিরভাগ দলিত মানুষ শিক্ষাবিহীন, চিকিৎসাবিহীন ও গৃহবিহীন। তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া দরকার। আবাসন সংকট, টয়লেট সংকট, বৃষ্টির দিনে ছাদ দিয়ে ঘরে পানি পড়া, ভারী বর্ষণে ড্রেনের ময়লা পানি ঘরে ঢোকাসহ নানা কষ্টে জর্জর তাদের জীবন। হরিজনরা একটি খুপরি ঘরে কয়েকটি পরিবার মিলে একসঙ্গে বসবাস করে। জায়গার অভাবে সবাই ঘুমাতে পারে না। পালাক্রমে একেকজনকে ঘুমাতে হয়। অনেক সময় ঘরের ভেতর কক্ষ বানাতে হয় পর্দা দিয়ে। তারা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা তেমন পায় না। অনেক সময় কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।

কাউকে পেছনে রেখে একটি সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না। তাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর বিশেষ জোর দেয়া উচিত। দলিত, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ও ট্রান্সজেন্ডারের মতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা এখনও সমাজে নানাভাবে পিছিয়ে রয়েছে। কেবল তা-ই নয়, এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা কত, তারও সঠিক হিসাব নেই। সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবে তাদের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যায় না। এ কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জাতীয় তথ্যভাণ্ডার প্রবর্তন করা প্রয়োজন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন।

অনগ্রসর সম্প্রদায় বা শ্রেণির মানুষ সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। চরম অবহেলিত, বিছিন্ন, উপেক্ষিত জনগোষ্ঠী হিসেবে তারা পরিচিত। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে জেলে, সন্ন্যাসী, ঋষি, বেহারা, নাপিত, ধোপা, হাজাম, নিকারী, পাটনী, কাওড়া, তেলী, পাটিকর, সুইপার, মেথর বা ধাঙ্গর, ডোমার, ডোম ও রাইত নিম্নশ্রেণির পেশার জনগোষ্ঠী। ‘বেদে এবং দলিত ও হরিজন জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন নীতিমালা, ২০১৩’ অনুযায়ী সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে সমাজের মূলস্রোতে তাদের আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ। সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপমতে, বাংলাদেশে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী কমবেশি ১৮ লাখ ৯০ হাজার, যদিও প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন তথা এ জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি দুটি একত্রে ছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ কর্মসূচি পৃথক হয়ে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি নামে স্বতন্ত্র কর্মসূচি হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে এ কার্যক্রমের বিশেষ ভাতা ও শিক্ষা উপবৃত্তির নগদ সহায়তায় জিটুপি পদ্ধতিতে উপকারভোগীর মোবাইল হিসাবে পাঠানো হচ্ছে।

জুলাই বিপ্লব মানুষের মনে আকাক্সক্ষা তৈরি করেছে। এখন যে কেউ চাইলেই সে আকাক্সক্ষার বাইরে যেতে পারবে না। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে সংস্কার করলে দেশের মানুষ দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাবে, আমাদের তা করতে হবে। আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। এতে সারাদেশের মানুষের মধ্যে নতুন আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে। সবার মধ্যে একটি ধারণা জšে§ছে যে, বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার এটাই সময়। বাংলাদেশ আর পেছনে ফিরবে না। তরুণ প্রজš§ নতুন বাংলাদেশ দেখতে চায় বা রাষ্ট্রব্যবস্থায় তারা পরিবর্তন চায়। তাই মানসিকতা পরিবর্তন করে সবাইকে মানুষের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। আর সেটা করতে পারলে বাংলাদেশ হবে বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশ, যা সবার প্রাণের দাবি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০