তরুণ যোদ্ধার আগমন

শামসুন নাহার: দেখতে দেখতে দাবার গুটি একদম ঘুরে গেল। ক’দিন আগেও সরকার, প্রেস সবই ছিল ধীরুভাইয়ের পক্ষে। সবাইকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন তিনি। আর নিয়ন্ত্রণ করার এই ক্ষমতা, এই জাদুর কাঠি তো একদিনে হাতে আসেনি। ধীরে ধীরে কত কাঠখড় পুড়িয়ে গড়ে তুলতে হয়েছে রিলায়ান্স সাম্রাজ্য। একটু একটু করে বুনতে হয়েছে ক্ষমতার জাল। তার মধ্যে সব এলোমেলো করে দিল ওয়াদিয়া। ব্যবসায় না পেরে শেষে ‘দেশি কাঁচামাল’ বলে সেকেলে ডিএমটির প্রচারণা চালিয়েছে। বলা যায় তাতে সফলও হয়েছে। দেশাত্মবোধের মোড়কে ক্যাম্পেইন করে সরকারের সুদৃষ্টি পেয়েছে বোম্বে ডায়িং। এখন আবার অতি আপনজন, পরমবন্ধু গোয়েঙ্কারও সহানুভূতি বাগাচ্ছে। তাই বলে গোয়েঙ্কাও ওয়াদিয়ার পক্ষ নেবেন! বৃদ্ধের ওপর অভিমান হয় আম্বানির। কিন্তু অভিমান পুষে রাখলে তো চলে না। প্রেসের সাহায্য লাগবেই। পাবলিক কোম্পানি চালাতে হলে জনগণের সহানুভূতি লাগবেই। বিনিয়োগকারীরাই মূল শক্তি। তাদের সমর্থন এনে দেবে মিডিয়া। সরকারকে চাপে রাখতেও মিডিয়াকে পক্ষে রাখতে হবে। মরিয়া হয়ে ধীরুভাই ফোন করলেন গোয়েঙ্কাকে। অনুরোধ করলেন যাতে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে ওয়াদিয়ার সঙ্গে একটি মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে দেন। এ লড়াইয়ের নিষ্পত্তি দরকার। তিনি মুরব্বি হিসেবে থেকে যেন টেক্সটাইল খাতের দুটি প্রধান কোম্পানির  মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সুরাহা বাতলে দেন। আম্বানির প্রস্তাব পছন্দ হলো গোয়েঙ্কার। নিষ্পত্তির পথে এগোলে তো সবার জন্যই ভালো। সেদিন বিকেলেই বৃদ্ধ ফোন করলেন ওয়াদিয়াকে। জানালেন ধীরুভাইয়ের প্রস্তাব। ওয়াদিয়া খানিকটা অবাকই হলেন। আম্বানির সঙ্গে কোনো প্রকার আলাপে আগ্রহী নন তিনি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য গোয়েঙ্কার জোরাজুরিতে সব সন্দেহ পাশে সরিয়ে রেখে কথা বলতে রাজি হলেন ওয়াদিয়া। বৈঠক বসবে এক্সপ্রেস পেন্টাহাউজেই।

নিচু একটি টেবিলে তিন পাশে তারা তিনজন বসলেন। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের এ বৈঠকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগ কথা আম্বানিই বললেন। প্রস্তাব করলেন, পলিয়েস্টার কাঁচামালের মার্কেটকে নিজেদের মধ্যে যুক্তিসঙ্গত উপায়ে ভাগাভাগি করে নেবে রিলায়ান্স ও বোম্বে ডায়িং। সীমার মধ্যে নিজেদের মতো করে ব্যবসা  তরুণ যোদ্ধার আগমন করবে। অথবা এও হতে পারে বোম্বে ডায়িংয়ের ডিএমটি বিক্রির জন্য খদ্দের জুগিয়ে দেবে রিলায়ান্স। বৈঠক শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃদ্ধ গোয়েঙ্কা জুতা খুলে নিচু টেবিলটায় পা তুলে আরাম করে বসেছিলেন। তারপর যতক্ষণ আলাপ চলেছে অর্থাৎ ধীরুভাই তার পরিকল্পনা বর্ণনা করছিলেন ততক্ষণ ধরে গোয়েঙ্কার পা মালিশ করে দিচ্ছিলেন। আগের দিনে মুখ ফসকে অপ্রীতিকর কথা বলে ফেলায় অনুতপ্ত হয়েছিলেন ধীরুভাই। তারই জন্য নিজস্ব উপায়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছেন হয়তো।

বৈঠক শেষে ওয়াদিয়াকে নিজের ছোট মেয়ে নিনার বিয়েতে আমন্ত্রণ জানালেন ধীরুভাই। ক’দিন বাদেই বিয়ে। তার অনুরোধ ওয়াদিয়া যেন বিয়েতে অবশ্যই সপরিবারে উপস্থিত থাকেন। এরপর হুট করে বুকে জড়িয়ে নিলেন ওয়াদিয়াকে। ওয়াদিয়া তো প্রায় চমকে উঠলেন। আশাই করেননি এমন কিছু। আম্বানি বললেন, ‘এখন তো আমরা বন্ধু, নাকি?’ এর উত্তরে কী বলা উচিত ভেবে পেলেন না ওয়াদিয়া। বেশ লজ্জায় পড়ে হুঁ-হ্যাঁ একটা কিছু বললেন আর কি। এরপর বিদায় নিয়ে লিফটের দিকে আগালেন ধীরুভাই। দরজার কাছে পৌঁছতেই হঠাৎ ফিরে দাঁড়ালেন। মাথা নুইয়ে প্রণাম জানালেন গোয়েঙ্কাকে। এরপর চলে গেলেন। লিফটের দরজা বন্ধ হতেই ওয়াদিয়া গোয়েঙ্কাকে বললেন, আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এই লিফট নিচতলা পৌঁছার আগেই সিদ্ধান্ত বদলাবে লোকটা। কীভাবে আবার আমার বুকে ছুরি বসানো যায় তার পাঁয়তারা করে ফেলবে।

ওয়াদিয়ার গাল ধরে একটু টেনে দিলেন গোয়েঙ্কা। মিষ্টি বকুনির গলায় বললেন, ‘খালি সন্দেহ তোমার।’

পরদিন ব্যালার্ড এস্টেটের অফিস থেকে ওয়াদিয়াকে ফোন করলেন আম্বানি। জানালেন, মেয়ের বিয়ের কার্ড দিতে নিজেই আসছেন ওয়াদিয়ার অফিসে। হঠাৎ এত আদিখ্যেতা কিছুটা বিব্রতকর ঠেকল ওয়াদিয়ার কাছে। তিনি অনুরোধ করলেন, এতটা কষ্ট না করে বরং কাউকে দিয়ে পাঠানোর জন্য। তাই করলেন আম্বানি। কিছুক্ষণ পরেই একজন এক্সিকিউটিভ হাজির হন কার্ড হাতে। বিয়ের দিন ওয়াদিয়াকে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য রিলায়ান্সের একজন ম্যানেজারকে পাঠানো হয়। নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা আগেই গিয়ে বসেছিলেন তিনি। ওয়াদিয়া অবশ্য তাকে ফেরত পাঠিয়ে বলেছেন তিনি নিজেই যেতে পারবেন। অনুষ্ঠানে পৌঁছে দেখা গেল, ওয়াদিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে আম্বানির বড় ছেলে মুকেশ। গাড়ি থেকে নেমেই অতিথিদের বিরাট লাইন। একে একে তারা এগিয়ে যাচ্ছেন মঞ্চের দিকে। মঞ্চে সদ্য বিবাহিত বর-কনের পাশে দাঁড়িয়ে অতিথিদের অভিবাদন জানাচ্ছেন আম্বানি ও আম্বানি পতœী। মুকেশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অনুষ্ঠান ভেন্যুতে এসে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ওয়াদিয়া পরিবারকে যেন সরাসরি লাইনের সামনে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু রাজি হননি ওয়াদিয়া। প্রায় ২০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করেন তিনি। ওয়াদিয়া মঞ্চে উঠতেই ফটো সাংবাদিকরা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তাদের  অস্বাভাবিক আগ্রহ লক্ষ্য করলেন ওয়াদিয়াও। দুটি টেক্সটাইল প্রতিপক্ষ একই মঞ্চেÑএটা খবর বটে। আবার অনুষ্ঠান স্থল ত্যাগ করার সময়ও আম্বানির ছোট ছেলে তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এগিয়ে আসে। এতেও রাজি হননি তিনি। ভদ্রভাবে দরকার হবে না বলে জানিয়ে দেন। আম্বানি পরিবারের নিমন্ত্রণ রক্ষা করার পুরো ব্যাপারটাই ওয়াদিয়ার জন্য এক অদ্ভুত বিব্রতকর অভিজ্ঞতা। যাই হোক, এটা শেষ হলো। কিন্তু এর কয়েক সপ্তাহ পরেই দুই পক্ষের বৈরিতা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

শত হলেও ব্যবসা বলে কথা। কাঠিয়াবারি বেনিয়া কি ব্যবসায় ছাড় দিতে পারে! আবেগের খাতিরে তো মুনাফার সুযোগ ছেড়ে দেওয়া যায় না। গোয়েঙ্কাও দেখলেন, ওয়াদিয়া তাহলে ঠিকই বলেছিল সেদিন। আবার রঙ পাল্টেছে গিরগিটিটা। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। এবার কড়া তদন্ত শুরু হবে। আর এ কাজটি করানোর জন্য বেছে নেবেন ভিন্ন ধাতের মানুষ। কোনো বিজনেস সাংবাদিক নয়, নামকরা সম্পাদকও নয়। এ কাজের দায়িত্ব দেবেন স্বামীনাথান গুরুমূর্তিকে। দক্ষিণ-ভারতীয় তরুণ অ্যাকাউন্ট্যান্ট গুরুমূর্তি। অডিট রিপোর্টের নিচে বাদে এ তরুণের নাম ছাপার অক্ষরে প্রকাশ পায়নি কখনও। একটিও রিপোর্ট করেননি আগে। অথচ আম্বানির গোমর ফাঁস করতে একেই খুঁজে পেলেন গোয়েঙ্কা!

৩৬ বছরের যুবক গুরুমূর্তি মাদ্রাজের ১৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এক প্রত্যন্ত গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে এসেছেন। প্রথমে গ্রামের স্কুল ও পরে মাদ্রাজের বিবেকানন্দ কলেজে পড়েছেন। এরপর ইচ্ছে ছিল আইন পড়ার। কিন্তু তা আর হয়নি। হিন্দু ধর্মের সর্বোচ্চ জাতে জš§ নেওয়াটাই কাল হলো তার। এর আগে টানা বহু বছর ধরে তামিলনাড়– রাজ্যে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন চলেছে। তাদের বক্তব্য হলো, জাতের শ্রেণিকরণে ব্রাহ্মণদের সবচেয়ে উঁচু স্তরে রাখা হয়েছে। ব্রাহ্মণরা এসেছে গৌরবর্ণের আরিয়ানদের থেকে, যারা উত্তরাঞ্চল থেকে ভারতের আদি জনগোষ্ঠী অর্থাৎ দ্রাবিড়দের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই জাত প্রথার মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে নিজেদের আধিপাত্য প্রতিষ্ঠা করেছে ব্রাহ্মণরা। বঞ্চিত হয়েছে তামিলনাড়–র প্রকৃত অধিবাসীরা। তাই সর্বক্ষেত্রে এখন কোটা পদ্ধতির প্রয়োগ করে এ বৈষম্য লাঘব করতে হবে। তামিলীয়দের অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে। এটাই ছিল তখনকার দিনে তামিলনাড়–র রাজনৈতিক চেতনা। আর এর বলি হয়েছেন গুরুমূর্তি। কোটা ব্যবস্থার কারণে আইনজীবী হওয়ার স্বপ্নকে ভুলে গিয়ে হিসাববিজ্ঞান নিয়ে পড়েন। ১৯৭২ সালে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে দেশেই একটি অডিট ফার্মে কাজ শুরু করেন।

গোয়েঙ্কার সঙ্গে গুরুমূর্তির পরিচয় ঘটে ১৯৭৫ সালে। বৃদ্ধের কোম্পানি নিবন্ধনের কাজ করে দেন তিনি। তার মেধা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হন গোয়েঙ্কা। নিজের প্রতিষ্ঠানে কাজে লাগাতে চান তাকে। কিন্তু এ প্রস্তাব গ্রহণ করেননি গুরুমূর্তি। তবে তখনকার চাকরি বাদ দিলে অবশ্যই গোয়েঙ্কার প্রতিষ্ঠানে যোগ দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন। ১৯৭৬ সালে ‘গুরু অ্যান্ড বর্ধন’ নামে নিজের অডিট ফার্ম খোলেন গুরুমূর্তি। গোয়েঙ্কার সঙ্গে পরিচয় থাকাটাই তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। বৃদ্ধের বিরাট সাম্রাজ্যের হিসাব-নিকাশ ও অডিটের কাজ পান গুরুমূর্তি। গোয়েঙ্কার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পান তিনি।

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০