মো. আবদুল্লাহ আল মামুন : বর্তমান সমাজে তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার ভয়াবহ হয়ে গেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজš§ তামাকজাত পণ্যের সেবন বেশি করে। বাংলাদেশ তামাকজাত পণ্য ব্যবহারে নবম স্থানে আছে। তারা সেবন করার জন্য রাস্তার গলি, ফুটওভার ব্রিজ, বিভিন্ন পার্কে অবস্থান করে। এতে শুধু তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, বরং জনসমক্ষে ধূমপান করাতে আশপাশের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ যিনি ধূমপান করেন, তিনি পুরো ধোঁয়া সেবন করেন না। ধোঁয়া তার নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু পাশের মানুষ ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ জনসমক্ষে ধূমপান করে। সেখানে বিশ্বের প্রথম দেশ ভুটানে জনসমক্ষে ধূমপান নিষিদ্ধ। অবশ্য বাংলাদেশে জনসমক্ষে ধূমপান রোধে আইন করা হয় ২০০৫ সালে। পরে আইন সংশোধন করা হয় ২০১৩ সালে। অবশেষে ২০১৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা করে। এতে শাস্তি হিসেবে জেল ও আর্থিক দণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু তা কখনও কার্যকর করা হয় না। আর একটি দেশে আইনের বাস্তবায়ন করা না গেলে অপরাধ বেড়ে যায়।
তামাকের ব্যবহার শুধু প্রকাশ্যে নয়, কিছু দোকানে আলাদা জায়গা রাখা হয় যেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ধূমপান করতে পারে। ঢাকা শহরের মিরপুর ও সাভারের এক সমীক্ষায় ৯৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রীদের লালায় নিকোটিনের উপস্থিতি পাওয়া পরোক্ষ ধোঁয়া থেকে।
বাংলাদেশে ৪ কোটি মানুষ তামাকজাত পণ্য সেবন করে। আর ১৫ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয় নানা অসুখ ব্যাধিতে। ফলে একজন মানুষ ধূমপান করে টাকা অপচয় তো করছে। অন্যদিকে রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা করতে হচ্ছে। তামাকজাত পণ্য এমন যাতে ক্ষতি ছাড়া কোনো উপকার নেই। প্রতি বছর তামাকজাত পণ্য থেকে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা আয় হলেও ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সচেতনতাই পারে তামাকজাত পণ্য থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু সিগারেটের প্যাকে লেখা থাকে ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এমনকি ছবি সংযুক্ত থাকে যেন মূর্খ মানুষ ও বুঝতে পারে। কিন্তু কেউ মেনে চলে না। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে ৫ লাখ ৭২ হাজার মানুষ, যা মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ। প্রতিদিন ৭৫০ জন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় এবং প্রতি বছরে ২৭ লাখ ৩ হাজার ৩৩৭ জন। এতে ১২ শতাংশ মানুষ ক্যান্সার, ৩৪ শতাংশ হƒদরোগ, ব্রংকাইটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হয়।
তামাকজাত পণ্য ধোঁয়া ছাড়াও হয়ে থাকে। আর এ পণ্য গ্রামের মহিলারা সেবন করে থাকে। যেমন জর্দা, গুল, চুরুট ইত্যাদি গালে দিয়ে খায়। এতে মুখে অনেক রকম রোগ দেখা দেয়। কারও দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এছাড়া জিহ্বায় ঘা হয়ে যায়। আর ধোঁয়া ছাড়া তামাক সেবন করে শুধু নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন নয়, অনেক শিশু বিকলাঙ্গ এবং মৃত জš§গ্রহণ করে। মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগী ছিল তামাকজাত পণ্যে আসক্ত। তামাক সেবন করে শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ। গ্রামে ৩৭ শতাংশ মানুষ তামাকজাত পণ্য সেবন করে এবং শহরে ২৯.৯ শতাংশ মানুষ। কারণ শহরে অধিকাংশ মানুষ শিক্ষিত। সুতরাং তারা জানে তামাকের ক্ষতি সম্পর্কে। কিন্তু গ্রামের মানুষ জানে ধূমপান ক্ষতিকর। তবে কী কী ক্ষতি হয় তা জানে না তারা।
তামাকজাত পণ্য উৎপাদন করতে ৩০ শতাংশ জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। এতে বন ধ্বংসের পাশাপাশি পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ দেখা দিয়েছে। বনের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু জ্বালানি যদি গৃহে রান্নার কাজে ব্যবহার করা যেত তাহলে এলপিজি গ্যাস কম লাগত। এছাড়া উর্বর জমিতে তামাকের চাষ করা হয়। এতে জমির উর্বরতা হ্রাস পায়। উল্লেখ্য, রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামে কৃষকদের তামাক চাষে আগ্রহী করা হচ্ছে। তাদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে তামাক চাষে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব। কিন্তু এটি মানুষের খাদ্যশস্যের মধ্যে অত্যাবশকীয় নয়। তারা এই চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে কৃষিজাত পণ্য থেকে দূরে চলে গেছে। কিন্তু এতে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়।
তবে আশার বাণী হলো, বাংলাদেশ ডঐঙ-এর অন্তর্ভুক্ত ঋৎধসবড়িৎশ ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঞড়নধপপড় ঈড়হঃৎড়ষ (ঋঈঞঈ) স্বাক্ষর করেছে ২০০৪ সালে। কিন্তু এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এর উদ্দেশ্য বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজš§কে তামাক সেবনের বিধ্বংসী স্বাস্থ্য, সামাজিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক পরিণতি এবং তামাকের ধোঁয়ার সংস্পর্শ থেকে রক্ষা করতে চায়। তামাকের বিপদগুলো উল্লেখ করে এবং বিশ্বব্যাপী সব প্রকারে এর ব্যবহার সীমিত করে সর্বজনীন মানদণ্ডের একটি সেট প্রণয়ন করে। এ লক্ষ্যে চুক্তির বিধানগুলো তামাক উৎপাদন, বিক্রয়, বণ্টন, বিজ্ঞাপন এবং কর আরোপকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন নিয়মগুলো অন্তর্ভুক্ত করে। ঋঈঞঈ মানগুলো, তবে ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা এবং স্বাক্ষরকারীদের তামাক নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর হতে উৎসাহিত করা হয়; যা চুক্তির প্রয়োজনের তুলনায়।
তাই এখনই উত্তম সময় তামাকজাত পণ্য প্রতিরোধ করা। ফলে পরিবার থেকে সচেতনতা শুরু করতে হবে। কারণ একজন শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিবার। অনেক সময় শিশু তার বাবাকে দেখে সিগারেট সেবন করা শেখে। মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রচারণা চালাতে হবে। যেমন বিভিন্ন পথনাটক, কমিউনিটি ক্যাম্পিং, যুবকদের জন্য কাউন্সেলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা, মাদকের চোরাচালান বন্ধ করা যেতে পারে। তবে যুবকদের জন্য কাউন্সেলিং সেন্টার খুবই উপযোগী। কারণ বয়ঃসন্ধিকালে আবেগের বশবর্তী হয়ে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে থাকে। কিন্তু তাদের যথাযথ কাউন্সেলিং করতে পারলে তামাকজাত পণ্যে আসক্ত হবে না। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করা। কারণ আইনের শাসন ছাড়া কোনো দেশ চলতে পারে না। এমন দৃষ্টান্ত দেখা যায়, যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে আছে তারাও তামাকজাত পণ্য সেবন করে। সুতরাং আমাদের উচিত তামাকজাত পণ্যের ভয়াবহতা মানুষের সামনে তুলে ধরে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। উল্লেখ্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এন্টি টোব্যাকো ক্লাব বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করছে।