শেয়ার বিজ ডেস্ক: রংপুর সদর উপজেলার হরিদেবপুর ইউনিয়নের কৃষক বাদশারুল ইসলাম। তিনি এ বছর প্রায় চার বিঘা জমিতে করেছেন তামাকের আবাদ। অথচ গত বছর তিনি আলু চাষবাদ করেছিলেন।
বাদশারুল ইসলাম বলেন, গত চার-পাঁচ বছর ধরে এ জমিগুলোতে আলু চাষ করছি। তবে এবার আলুর বীজের যে দাম, সঙ্গে সার কীটনাশকও আছে, তাই কোম্পানি থেকে টাকা নিয়ে তামাক লাগাইছি। এখন আর লোকসানের চিন্তা নেই।
বাদশারুল ইসলামের মতো জেলার বেশিরভাগ কৃষকই এবার আলুর জমিতে চাষ করেছেন তামাক। কৃষকরা বলছেন, অন্যান্য ফসল চাষে বীজ, সার, সেচসহ উৎপাদন খরচ বাড়ছে। অন্যদিকে বিভিন্ন তামাকজাত কোম্পানি তামাক চাষে নানা রকম সহায়তা করছে। যে কারণে ক্ষতি জেনেও তামাক চাষ করছেন তারা।
কয়েক বছর আগেও রংপুরের যেসব আবাদি জমিতে ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা ও আলুসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয়েছিল, সেসব জমিতে এখন তামাক চাষ হচ্ছে। তামাকজাত কোম্পানির প্রলোভন ও অধিক মুনাফার আশায় তামাক চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষকেরা। শুধু তাই নয়, কৃষি বিভাগের নীরবতায় কোথাও কোথাও প্রণোদনার সারেও তামাক চাষের অভিযোগ উঠেছে।
সরেজমিনে রংপুর জেলার সদর, গংগাচড়া, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, মিঠাপুকুরসহ বেশ কয়েকটি উপজেলা ঘুরে একই চিত্র পাওয়া গেছে। বছরের এই সময়ে জমিগুলোতে আলুসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন করা হলেও এবার চিত্র কিছুটা ভিন্ন। ফসলের অধিক দাম আর তামাকজাত কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন সহায়তার কারণে বেড়েই চলেছে তামাকের আগ্রাসন। তবে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিসম্পন্ন তামাক চাষ বন্ধে প্রশাসন কিছু পদক্ষেপ নিলেও মাঠ পর্যায়ে তেমন সাড়া মিলছে না।
একাধিক চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তামাক চাষে তাদের উৎসাহের নেপথ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, আকিজ টোব্যাকো, নাসির টোব্যাকো, আবুল খায়েরসহ বিভিন্ন তামাকজাত কোম্পানি রয়েছে। চাষ পূর্ববতী ও পরবর্তী বিশেষ সহায়তা দিয়ে থাকে এসব বহুজাতিক কোম্পানি। তামাক চাষে বীজ ও সার ক্রয়ের জন্য নগদ টাকাসহ নানান উপকরণ সরবরাহ ও নিয়মিত তদারকি করে কোম্পানির প্রতিনিধিরা। এসব সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি দাম ভালো পাওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও তামাক চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। একই সঙ্গে বিকল্প ফসল উৎপাদনে খরচ বেশি ও ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা না থাকায় তামাক চাষে আগ্রহ বাড়ছে অনেক কৃষকের।
তারাগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর, বাছুরবান্ধা, জয়বাংলা, হাতীবান্ধা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ধান, গম, ভুট্টা ও সরিষা ক্ষেতের পাশাপাশি বিষাক্ত তামাকে বিস্তৃত ফসলি জমি। খেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। আর সময় মতো উৎপাদিত তামাক বুঝে নিতে মাঠে তদারকি করছেন চুক্তিবদ্ধ তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা।
বারাপুর গ্রামের কৃষক খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, প্রতি বছর দেড় বিঘা জমিতে গম, ভুট্টা ও সরিষা চাষ করতাম। এই চাষাবাদ দিয়ে সংসারের চাহিদা মেটানো যেত। কিন্তু দিন দিন সার, বীজ, সেচসহ অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন তামাক চাষ করছি। তাছাড়া অন্যান্য ফসলে পরিশ্রম বেশি লাভ কম। তামাক চাষে সেই কষ্টটা হয় না।
হাজীপুর ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জামিনুর ইসলাম সাদ্দাম জানান, তারাগঞ্জ উপজেলার মধ্যে ওই ব্লকে তামাকের চাষ বেশি হয়ে থাকে। কৃষকেরা অন্যান্য ফসল চাষাবাদের জন্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা পায় কিন্তু তামাকে বেশি লাভের সম্ভাবনা থাকায় তারা তামাকে আগ্রহী।
কৃষি বিভাগ বলছে, দীর্ঘ সময় রংপুর অঞ্চলে তামাকের যে আগ্রাসন সেটি কমাতে নানা উদ্যোগ নিলেও সফলতা খুব একটা আসেনি। সচেতনতার অভাব এবং বেশি লাভের আশায় কৃষকেরা তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছে। অথচ গবেষণায় দেখা যায়, তামাকজনিত রোগে প্রতি বছর দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। তারপরও কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না তামাকের আগ্রাসন।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছর রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় তামাকের চাষ হয়েছে ১৩ হাজার ৯৪৯ হেক্টর জমিতে। গত বছর যা ছিল ১০ হাজার ৮২০ হেক্টর। এ মৌসুমে শুধু রংপুর জেলায় ১ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে রংপুর মেট্রোপলিটন এলাকায় ১০ হেক্টর, রংপুর সদর উপজেলাতে ৩৪৫ হেক্টর, গংগাচড়ায় ৫১০ হেক্টর, বদরগঞ্জে ১৫ হেক্টর, তারাগঞ্জ ৯৬০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে।
রংপুরের আট উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি তামাকের চাষাবাদ হয়ে থাকে তারাগঞ্জে। এ প্রসঙ্গে জানতে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উর্মি তাবাসসুম বলেন, আমরা কৃষককে তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করেছি। অল্প খরচে লাভ বেশি পাওয়ায় কৃষকেরা তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তামাক চাষে কৃষকরা ক্ষতি জেনেও তাদের নিরুৎসাহিত করা সম্ভব হচ্ছে না। গত বছরের তুলনায় এবারে তারাগঞ্জে ৬০ হেক্টর তামাক চাষ বেড়েছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, সচেতনতার অভাবে মানুষ তামাক চাষ করছেন। লাভ বেশি হলেও তামাক চাষে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে এবং পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। সরকার কৃষি খাতকে সমৃদ্ধ করতে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করছে। তবে তামাক নিরুৎসাহিত ফসল, বিগত দিনের তুলনায় চাষ কমেছে।