তামাক নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত সভায় তামাক-সংশ্লিষ্টদের আমন্ত্রণ!

নিজস্ব প্রতিবেদক:‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’-সংক্রান্ত সভায় বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতিকে আমন্ত্রণ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো। তামাক-সংশ্লিষ্টদের বাদ দিয়ে সভা করার দাবি জানিয়েছে তারা। তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর নেতাদের দাবি, সভায় তামাক-সংশ্লিষ্টদের আমন্ত্রণ জানানো আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) লঙ্ঘন।

তারা বলছেন, কিশোর-যুবসমাজকে সিগারেট সেবনে উৎসাহী করতে সিগারেট কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় নেমেছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তামাক নিয়ন্ত্রণ গাইডলাইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সিগারেট বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন নিষিদ্ধ করেছে। সিগারেট কোম্পানিগুলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগকে বন্ধে অপচেষ্টা ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আগামীকাল অনুষ্ঠেয় ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’-সংক্রান্ত সভায় সভাপতিত্ব করবেন সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ। সভায় বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকেও আমন্ত্রণ জানোনোয় অনুষ্ঠেয় বৈঠকটি বাতিলের দাবি জানিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর চিঠি দিয়েছে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো।

এ প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) সভাপতি ড. অরূপ রতন চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ‘২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ ঘোষণা বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের একটি অন্যতম হাতিয়ার। তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গাইডলাইন বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত বৈঠকে তামাক-সংশ্লিষ্টদের আমন্ত্রণ সরাসরি আইনের লঙ্ঘন। আমরা ইতোমধ্যে মন্ত্রী ও সচিবকে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছি। আমরা এটির প্রতিবাদ করছি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তামাক নিয়ন্ত্রণের গাইডলাইন কার্যকর থাকলে সিগারেট কোম্পানির তরুণদের ধূমপানে আকৃষ্ট করার অপচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবে। লাইসেন্স ব্যবস্থা কার্যকরের মাধ্যমে একটি এলাকায় তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি সীমিত হয়ে যাবে। যার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে এ গাইডলাইন অকার্যকর করার জন্য। তারা নীতিনির্ধারকদের বিভিন্নভাবে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে, যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও তারা করে থাকে।

গত ৯ নভেম্বর স্থানীয় সরকার সচিবকে লেখা চিঠিতে জাতীয় যক্ষ্মা নিরোধ সমিতির (নাটাব) সভাপতি মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের সভাপতি কাজী রফিকুল আলম, বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকি ও উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতারের স্বাক্ষর রয়েছে।

চিঠিতে তারা বলেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তামাক নিয়ন্ত্রণ গাইডলাইন-বিষয়ক সভায় তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানোর খবরে তারা উৎকণ্ঠিত।

চিঠিতে বলা হয়, স্থানীয় সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ গাইডলাইন বাংলাদেশ সংবিধান অনুচ্ছেদ ১৮(১) এবং স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯ তফসিল ১ ও ৫ অনুসারে  জনস্বাস্থ্য রক্ষায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই গাইডলাইন অনুসারে, তামাকজাত বিক্রেতাদের লাইসেন্সের আওতায় এনে বিক্রয় সীমিতকরণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘোষণা বাতিলের জন্য তামাক কোম্পানিগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে। কারণ তাদের প্রধানতম টার্গেট শিশু-কিশোর-যুবক। এদের সিগারেটের নেশা ধরিয়ে দিতে পারলেই তাদের দীর্ঘমেয়াদি ভোক্তা তৈরি হয়ে যায়।

বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোটের সমন্বয়কারী সাইফুদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগ যেন গাউডলাইন বাস্তবায়ন করা থেকে পেছনে ফিরে না আসে। তারা যেন তাদের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বহাল থাকে, এটিই আমাদের প্রত্যাশা। এফসিটিসির নীতিমালা অনুযায়ী সরকার তামাকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করতে পারে না।

ঢাকা আহছানিয়া মিশনের পরিচালক (তামাক নিয়ন্ত্রণ) ইকবাল মাসুদ শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে (এফসিটিসি) প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ। এফসিটিসির ৫.৩ নম্বর আর্টিকেল অনুযায়ী তামাক-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সরকার বৈঠক করতে পারে না। দেড় বছর ধরে যে গাইডলাইন তৈরি হয়েছে, মাঠপর্যায়ে সেটি বাস্তবায়নে বাধা দিতে তামাক কোম্পানির লোকজন উঠে পড়ে লেগেছে। আমরা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গাইডলাইন বাস্তবায়নের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আয়োজিত আগামীকালকের এ-সংক্রান্ত বৈঠকে তামাক-সংশ্লিষ্টদের আমন্ত্রণের প্রতিবাদ জানাই। তাদের বাদ দিয়ে এ বৈঠক করার আহ্বান জানাই। নতুবা এ বৈঠকটি বাতিল করা হোক।

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির প্রকল্প পরিচালক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক শেয়ার বিজকে বলেন, সভায় তামাক-সংশ্লিষ্টদের আমন্ত্রণ প্রধানমন্ত্রীর ‘২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ ঘোষণার অন্তরায়। এটি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) লঙ্ঘন। এতে আমাদের তীব্র আপত্তি আছে। আমরা চাই সভাটি বাতিল করা হোক।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে (এফসিটিসি) প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ। এ চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জনস্বাস্থ্যনীতি বিষয়ে তামাক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সভা ও আলোচনা এ চুক্তির পরিপন্থি। কারণ, তামাক কোম্পানিগুলো সরকারের জনস্বাস্থ্য রক্ষার চেষ্টাকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত করে। সরকারের উদ্দেশে তামাক ব্যবহার কমিয়ে আনা, আর কোম্পানি মুনাফার স্বার্থে সরকারের এই জনস্বার্থমূলক কাজে বাধার সৃষ্টি করে। তাদের লক্ষ্য তামাক সেবন বাড়ানো। বিশেষ করে যুবসমাজকে ধূমপানে আকৃষ্ট করতে কাজ করে। তাই সরকার ও তামাক কোম্পানির উদ্দেশ্য পরস্পর সাংঘর্ষিক। আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) আর্টিকেল ৫.৩তে জনস্বাস্থ্য রক্ষার নীতিকে সুরক্ষায় বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০