রোহান রাজিব: বেসরকারি খাতের গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক তীব্র তারল্য সংকটে ভুগছে। তারা গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে তারল্য সহায়তা চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে ব্যাংক দুটি। রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের আগস্ট মাসের ভেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য প্রায় ৫ কোটি টাকার নগদ তহবিল সুবিধা চেয়েছে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। আর মার্জার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বিশেষ তারল্য সহায়তা অব্যাহত রাখার অনুরোধ করেছে পদ্মা ব্যাংক।
সম্প্রতি গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সংকট থেকে উত্তরণে আরেক সমস্যাগ্রস্ত বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে কয়েক মাস আগে একীভূত হওয়ার চুক্তি করেছে পদ্মা ব্যাংক। জানা যায়, ২০১৩ সালে যাত্রা করে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক)। কয়েকদিন পর ব্যাংকটিতে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারকে। তার সময় নামে-বেনামে টাকা বের করে নেয়ার পর ব্যাংকটি আর খুব একটা ঋণ বিতরণ করেনি। বছরের পর বছর এসব ঋণ আর আদায় হয়নি। প্রতিবছর সুদযুক্ত হয়ে তা শুধু বাড়ছে। চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ১৩ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, যার ১২ হাজার কোটি টাকার সুবিধাভোগী এস আলম গ্রুপ।
এস আলমের প্রভাব মুক্ত করতেই ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙে নতুন পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান ও স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়েছে মেঘনা ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ নুরুল আমিনকে। তার সঙ্গে থাকা অপর চার স্বতন্ত্র পরিচালক হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক জামাল মোল্লা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক ডিএমডি নুরুল ইসলাম খলিফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের অধ্যাপক আবু হেনা রেজা হাসান ও হিসাববিদ মু. মাহমুদ হোসেন। ব্যাংকটির পুনর্গঠিত পর্ষদের সঙ্গে তারল্য সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠকও হয়। কীভাবে তারল্য সংকট থেকে উত্তরণ করা যায় তার একটি রোডম্যাপও প্রণয়ন করা হয়। এর মধ্যেই রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের আগস্ট মাসের ভেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য প্রায় ৫ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা চেয়ে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি দিয়েছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাবিব হাসনাত। চিঠিতে বলা হয়, পাওলা নিট ওয়্যার, ট্যাঙ্গন গার্মেন্টস, নিয়ার নিট ফ্যাশন, এম. আর ফ্যাশন এবং নাজিফা ফ্যাশন রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক কর্মচারীদের আগস্ট মাসের বেতন-ভাতা বাবদ ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা দিতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রাখার স্বার্থে বেতন-ভাতাদি জরুরি ভিত্তিতে পরিশোধ করা প্রয়োজন।
চিঠিতে আরও বলা হয়, এসব প্রতিষ্ঠানের হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রা ও টাকা থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের তারল্য সংকটের কারণে বেতন-ভাতা পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বেতন-ভাতা পরিশোধ করা না হলে শ্রমিক অসন্তোষ এবং কারখানা অচল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা পোশাকশিল্পে চলমান অস্থিতিশীল অবস্থা আরও বেড়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় সচল রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকূলে ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকার বেতন-ভাতা বাবদ নগদ তহবিল সুবিধা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলো। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ব্যাংকটির এমডি সৈয়দ হাবিব হাসনাত এবং নতুন পর্ষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিনের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তারা ধরেননি।
এদিকে গত ২৫ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সংরক্ষিত চলতি হিসাবে বিশেষ তারল্য সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয় পদ্ম ব্যাংক। চিঠিতে বলা হয়, বর্তমান ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক তারল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় মারাত্মক তারল্য সংকটে পড়েছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক হতে রেপোর মাধ্যমে ধারসহ আর্থিক সুবিধা নিয়ে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করছে পদ্মা ব্যাংক। এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে মার্জের জন্য পদ্মা ব্যাংকের চুক্তি হয়। ফলে আমানতকারীদের মধ্যে একরকম অনাস্থা ও শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকটিতে গ্রাহকদের আমানত উত্তোলনের চাপ তীব্র হয়েছে। অনেক গ্রাহক তাদের দীর্ঘস্থায়ী আমানত ও স্কিম আমানত মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে উত্তোলন করছেন। লিগ্যাসি আমানতসহ গ্রাহকদের দৈনন্দিন চাহিদা জোগান দিতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা হিমশিম খাচ্ছে এবং শাখা ও উপশাখা চরম হুমকির মধ্যে রয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, একীভূত ও মার্জার প্রক্রিয়া চলমান থাকার কারণে নতুন আমানত আনাও ব্যাংকের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তারল্য সুবিধা নিয়ে এখনও ব্যাংকিং কার্যক্রম চলছে। এমতাবস্থায় মার্জার কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য সহায়তা দেয়ার বিশেষ অনুরোধ করা হয় চিঠিতে। এ বিষয়ে পদ্মা ব্যাংকেরও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
২০১৩ সালের চতুর্থ প্রজšে§র ব্যাংক হিসেবে অনুমোদন পায় সাবেক ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা)। চতুর্থ প্রজšে§র ব্যাংকের মধ্যে এ ব্যাংকেই বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে কার্যক্রম শুরুর কয়েক বছরের মধ্যে। এরপর ব্যাংকটির পর্ষদে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে করা হয় পদ্মা ব্যাংক। ২০১৭ সালে এ ব্যাংকটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত হয় সরকারি একাধিক ব্যাংক ও সংস্থা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রগুলো জানায়, এ দুটিসহ অন্তত ১০ ব্যাংক ভয়াবহ তারল্য সংকটে রয়েছে। বিদায়ী গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এস আলমের মালিকানাধীন সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর সিআরআর ও এসএলআর এবং চলতি হিসাব ঘাটতি থাকার পরও লেনদেন কার্যক্রম চালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তবে নতুন গভর্নর আসার পর সে সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যেই ঘোষণা দেয়া হয়েছে, কোনো ব্যাংকে আর টাকা ছাপিয়ে সহায়তা দেয়া হবে না। বরং সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে তারল্য সুবিধা দেয়া হবে আন্তঃব্যাংক থেকেই। এর অংশ হিসেবে ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে নতুন নীতিমালা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে গ্যারান্টারের ভূমিকায় থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কী পদ্ধতিতে এ গ্যারান্টার হবে, তা নিয়ে পর্যালোচনা চলছে।