রহমত রহমান: খুলনার লকপুর শিল্পগোষ্ঠী। গ্রুপের সহযোগী তিন প্রতিষ্ঠানের বন্ড সুবিধার অপব্যবহার কোনোভাবেই থামছে না। বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামাল পণ্য উৎপাদনের কথা। কিন্তু গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান তা সরাসরি খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। একাধিকবার মামলা ও জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু বন্ড সুবিধার অপব্যবহারে তিনটি প্রতিষ্ঠানই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
অবশেষে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও শুল্ককর ফাঁকি প্রমাণিত হওয়ায় তিনটি প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত ও বিন (ব্যবসায়িক শনাক্তকরণ নম্বর) লক করা হয়েছে। সম্প্রতি মোংলা কাস্টম হাউস ফাঁকি উদ্ঘাটন করে লাইসেন্স স্থগিত ও বিন লক করে আদেশ জারি করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এনবিআর সূত্র জানায়, লকপুর গ্রুপের বন্ডেড প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে এনবিআরের নির্দেশে মোংলা কাস্টম হাউস বিষয়টি খতিয়ে দেখে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১ সেপ্টেম্বর মোংলা কাস্টম হাউস পৃথক টিম তিনটি প্রতিষ্ঠানের বন্ড গুদাম পরিদর্শন করে। পরে তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেওয়া হয়, যাতে রাজস্ব ফাঁকি প্রমাণিত হওয়ায় তিনটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত ও বিন লক করা হয়। সম্প্রতি মোংলা কাস্টম হাউস কমিশনার হোসেন আহমদের সই করা পৃথক আদেশ জারি করা হয়। তিনটি প্রতিষ্ঠান হলোÑবাংলাদেশ পলি প্রিন্টিং ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, মুনস্টার পলিমার এক্সপোর্ট লিমিটেড ও ইস্টার্ন পলিমার লিমিটেড।

বাংলাদেশ পলি প্রিন্টিং ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের প্রতিবেদনে বলা হয়, নওয়াপাড়া, ফকিরহাট, বাগেরহাটে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালে বন্ড লাইসেন্স পায়। অভিযোগের ভিত্তিতে ১ সেপ্টেম্বর কাস্টম হাউস টিম প্রতিষ্ঠানটি সরেজমিন পরিদর্শন করে। এ সময় বন্ড গুদামে বন্ড রেজিস্টার অনুযায়ী, ৪ হাজার ৬০৮ দশমিক ৮৮ মেট্রিক টন কাঁচামাল কম পাওয়া যায়, যার মধ্যে দুই হাজার ৪৮৬ দশমিক ৩৪ মেট্রিক টন পিপি/এলডিপিই, ৫৭৫ দশমিক ৬৫ মেট্রিক টন পিপি ফিল্ম, ৪১৮ দশমিক ৭৯ মেট্রিক টন ডুপ্লেক্স বোর্ড ও ৫৩৭ দশমিক ৩৭ মেট্রিক টন গাম। এসব কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। যার শুল্ককর প্রায় ১৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
প্রতিষ্ঠানটি কাস্টমস আইনের বন্ড লাইসেন্সের শর্ত এবং আমদানি ও ইনবন্ড-সংক্রান্ত এনবিআরের আদেশ লঙ্ঘন করেছে। সরকারি রাজস্বহানির পরিমাণ নির্ধারণ ও মামলা দায়েরের কার্যক্রম অব্যাহত রেখে সরকারি রাজস্ব নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে কাস্টমস আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত, বিন লক করা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পলি প্রিন্টিং ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের বিরুদ্ধে এর আগেও বন্ড সুবিধার অপব্যবহারে মামলা করেছে মোংলা কাস্টম হাউস। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৬৯ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি প্রমাণিত হওয়ায় ৪০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন।
ইস্টার পলিমার লিমিটেডের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি মোংলা ইপিজেডে অবস্থিত। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১ সেপ্টেম্বর মোংলা কাস্টম হাউস টিম প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করেন। এ সময় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হয়, করোনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানের নথি, বন্ড রেজিস্টার, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬১টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে আমদানি করা কাঁচামাল ও উপকরণ রেজিস্টারে এন্ট্রি করা হয়নি। যার মধ্যে রয়েছে ৯৬০ দশমিক ৮৩ মেট্রিক টন বিওপিপি, ৭৪৫ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন পিপি/এলডিপিই, ৩৯২ দশমিক ৬১ মেট্রিক টন আটকার্ড, ৬৭ দশমিক ২০ মেট্রিক টন ইথাইল এসিটেট, ৪৯ দশমিক ৭৮ মেট্রিক টন থিনার, ৪৫ দশমিক ৭৭ মেট্রিক টন হোয়াইট লাইনার পেপার, ৪ দশমিক ৯০ মেট্রিক পিপি ইঙ্কজেট কাঁচামাল বন্ড রেজিস্টারে এন্ট্রি না করে অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এসব কাঁচামালে জড়িত রাজস্ব প্রায় ৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অপব্যবহারের অভিযোগে লাইসেন্স স্থগিত ও বিন লক করা হয়।
মুনস্টার পলিমার এক্সপোর্ট লিমিটেডের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি মোংলা ইপিজেডে অবস্থিত। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১ সেপ্টেম্বর মোংলা কাস্টম হাউস টিম প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করেন। এ সময় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ পাওয়া যায়।

প্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হয়, করোনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। পরে প্রতিষ্ঠানের নথি, বন্ড রেজিস্টার, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৮টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে আমদানি করা কাঁচামাল ও উপকরণ রেজিস্টারে এন্ট্রি করা হয়নি। যার মধ্যে রয়েছে ৩২০ দশমিক ৮৭ মেট্রিক টন বিওপিপি, ৬৭৬ মেট্রিক টন পিপি/এলডিপিই, ৫৯৫ দশমিক ৩৭ মেট্রিক টন আটকার্ড, ৪৫৩ মেট্রিক টন গাম, ১০৪ দশমিক ৬১ মেট্রিক টন থিনার, ৬৯৮ দশমিক ১১ মেট্রিক টন ডুপ্লেক্স বোর্ড কাঁচামাল বন্ড রেজিস্টারে এন্ট্রি না করে অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এসব কাঁচামালে জড়িত রাজস্ব প্রায় ৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অপব্যবহারের অভিযোগে লাইসেন্স স্থগিত ও বিন লক করা হয়।
এ বিষয়ে মোংলা কাস্টম হাউসের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আগে বন্ড সুবিধার অভিযোগে বহুবার মামলা, জরিমানা হয়েছে। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানেরও অপব্যবহার বন্ধ হয়নি। কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করে সরাসরি খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়। এবারও তিনটি প্রতিষ্ঠানের একইভাবে কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মূলত রাজস্ব ফাঁকি দিতেই প্রতিষ্ঠানগুলো বেপরোয়াভাবে কাঁচামাল অপসারণ করছে। তিনটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স সাময়িকভাবে স্থগিত ও বিন লক করা হয়েছে। আরও তদন্ত করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে লকপুর গ্রুপের চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি অসুস্থ। আমি খুলনা প্রিন্টিং ছাড়া অন্যগুলো দেখি না।’ তিনটি প্রতিষ্ঠানের বন্ড সুবিধার অপব্যবহার, লাইসেন্স স্থগিত ও বিন লক বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টি জানি না। আজই আপনার থেকে শুনলাম।’
অপরদিকে, লকপুর গ্রুপের আরেক বহুল আলোচিত বন্ডেড প্রতিষ্ঠান খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড (কেপিপিএল)। পুঁজিবাজার তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৩৯৪ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে এনবিআর। বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করে তা রপ্তানি না করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে একটি, কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালে দুটি মামলা চলমান রয়েছে।