তিন বছরেই পিডিবির লোকসান ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা

**বিদ্যুৎ খাতে গত ১৫ বছরের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেছে শেয়ার বিজ। এতে দুর্নীতি-অনিয়ম ছাড়াও ভর্তুকি, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে। এ খাতের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ নিয়ে আজ থাকছে ধারাবাহিকের তৃতীয় পর্ব

ইসমাইল আলী: দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা দেড় দশকে পাঁচগুণ হয়েছে। উৎপাদন সক্ষমতাও পাঁচগুণ ছাড়িয়ে গেছে। তবে এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কয়েকগুণ হয়েছে। এতে প্রতি বছর বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। সে ঘাটতি পূরণে একদিকে সরকার ভর্তুকি হিসেবে ঢেলেছে মোটা অঙ্কের অর্থ, অন্যদিকে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। ফলে বিদ্যুৎ সমস্যার টেকসই কোনো সমাধান হয়নি।

পিডিবির হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৬ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটি লোকসান গুনেছে দুই লাখ দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে লোকসানের এ চিত্র সবসময় সমান ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের শুরুর দিকে এ লোকসান অনেক কম ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তা অনেক বেড়ে গেছে। এর মধ্যে গত তিন অর্থবছর ধরে রেকর্ড পরিমাণ লোকসান গুনেছে পিডিবি।
সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর পিডিবি লোকসান গুনেছিল মাত্র ৮২৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। পরের (২০০৯-১০) অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৬৩৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। তবে ২০১০-১১ অর্থবছর লোকসান এক লাফে সাতগুণের বেশি বেড়ে হয় চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছর তা আরও ৪৪ শতাংশ বেড়ে হয় ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে ২০১২-১৩ অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

পরের দুই অর্থবছর পিডিবির লোকসান আবারও বাড়ে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছর লোকসান ৩৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছর প্রায় সাত শতাংশ বেড়ে হয় সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পিডিবির লোকসান প্রায় ৪৭ শতাংশ কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর পিডিবির লোকসান আবারও বাড়ে। ওই অর্থবছর লোকসান দাঁড়ায় চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

২০১৭-১৮ অর্থবছর পিডিবির লোকসান অনেকখানি বাড়ে। ওই অর্থবছর ১১০ শতাংশ বেড়ে সংস্থাটির লোকসান দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা। তবে পরের দুই অর্থবছর তা আবার কমে। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর লোকসান হয় আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ও ২০১৯-২০ অর্থবছর সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। তবে ২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবির লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবি লোকসান গুনেছিল ৩২ হাজার ৮৯১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ৫১ হাজার ৩০০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। আর বিদায়ী অর্থবছর সংস্থাটির লোকসান দাঁড়িয়েছে (প্রাক্কলিত) ৪১ হাজার ১২১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ শেষ তিন বছরে পিডিবি লোকসান গুনেছে এক লাখ ২৫ হাজার ৩১২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। যদিও আগের ১৩ বছরে লোকসান ছিল প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা।

এদিকে লোকসানের ঘাটতি পূরণে নিয়মিতই বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে সরকার। তবে শেষ তিন অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিদায়ী অর্থবছর ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছর ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল ২৯ হাজার ৬১১ কোটি ও ২০২১-২২ অর্থবছর ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন বছরে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৭৫ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। যদিও ২০০৮-০৯ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ১৩ বছরে ভর্তুকি দেয়া হয় ৬২ হাজার ৩০১ কোটি টাকা।
এ হিসাবে ১৬ বছরে পিডিবিকে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। কিন্তু এ সময় পিডিবি লোকসান গুনেছে দুই লাখ দুই হাজার ৮৬ কোটি টাকা। এ ঘাটতি মেটাতে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ঘাটতি ও ভর্তুকি অনেক বেড়ে যাওয়ায় চাপে পড়ে সরকার। তাই ভর্তুকি কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তে বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গত মে মাসে আইএমএফের প্রতিনিধি দলের কাছে এ-সংক্রান্ত পরিকল্পনাও তুলে ধরা হয়।

এতে দেখা যায়, ঘাটতি মেটাতে ২০২৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১১ বার বাড়ানো হবে বিদ্যুতের দাম। তবে গ্রীষ্ম নয়, বরং শীতের সময় বিশেষত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হবে। এক্ষেত্রে প্রতিবারই পাঁচ শতাংশ হারে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বিদ্যমান হারের চেয়ে কিছুটা বাড়লেও ১১ দফায় পাঁচ শতাংশ হারে বৃদ্ধির ফলে এ খাতে ভর্তুকি শূন্যে নেমে আসবে।
আইএমএফের সঙ্গে বৈঠকে জানানো হয়, বাল্ক বিদ্যুতের মূল্যহার গত ফেব্রুয়ারিতে গড়ে পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে বাল্ক বিদ্যুতের দাম পড়ছে ভারিত গড়ে সাত টাকা চার পয়সা। যদিও বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বাল্ক সরবরাহ মূল্য প্রায় ১১ টাকা ৯৬ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রিতে পিডিবির লোকসান হচ্ছে চার টাকা ৯২ পয়সা।

অন্যদিকে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গত ফেব্রুয়ারিতে গড়ে আট দশমিক ৪৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে বিদ্যুতের খুচরা মূল্যহার পড়ছে ভারিত গড়ে আট টাকা ৯৫ পয়সা। এছাড়া ডিমান্ড চার্জ ও অন্যান্য সেবা ফি গড়ে ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে ফেব্রুয়ারিতেই। এতে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর ঘাটতি প্রায় পূরণ হয়ে গেছে। তবে বাল্ক পিডিবির ঘাটতি পূরণে অর্ধপ্রান্তিক (দেড় মাস) বা প্রান্তিক (তিন মাস) অথবা ষাণ¥াসিক (ছয় মাস) অন্তর অন্তর বাল্ক ও সে অনুপাতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো উচিত।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০