নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন আইন করা হয়েছে। সিগারেটের প্যাকেটে সতর্কীকরণ প্রচারণা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রতি বছর শুল্কহার বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এতে সিগারেটের দাম প্রতিবার বাজেটের পর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরপরও কোনোভাবেই সিগারেট ব্যবসায় লাগাম টানতে পারছে না সরকার। বরং তা বিক্রি থেকে আয় বেড়েই চলেছে বাংলাদেশে সিগারেট উৎপাদন ও বিক্রির জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর (বিএটি)।
দেশের বাজারে সিগারেটের বড় অংশই সরবরাহ করছে বিএটি। এতে প্রতিবছর ব্যবসা ও মুনাফা বেড়ে চলেছে কোম্পানিটির। সর্বশেষ গত তিন বছরে (২০২১ থেকে ২০২৩ সাল) বিএটি সিগারেট বিক্রি করেছে এক লাখ ১০ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকার। এই সময়ে কোম্পানিটি সিগারেট বিক্রি করেছে প্রায় ২০ হাজার কোটি স্টিক। আর তিন বছরে বিএটি মুনাফা করেছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বিএটির বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, করোনার পর মানুষের মাঝে সিগারেট খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। ২০২০ সালে বিএটি পাঁচ হাজার ২৫৪ কোটি ৩০ লাখ স্টিক সিগারেট বিক্রি করেছিল। তবে ২০২১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ছয় হাজার ৩০০ কোটি স্টিক, ২০২২ সালে ছয় হাজার ৫৪৪ কোটি ৬০ লাখ স্টিক ও ২০২৩ সালে সাত হাজার ১২৯ কোটি ৯০ লাখ স্টিক। অর্থাৎ গত তিন বছরের ব্যবধানে কোম্পানির সিগারেট বিক্রি বেড়েছে এক হাজার ৮৭৫ কোটি ৬০ লাখ স্টিক।
সিগারেট বিক্রি বাড়ার প্রভাবে আয় ও মুনাফা উভয়ই বেড়েছে বিএটির। তথ্যমতে, কোম্পানিটি গত ২০২৩ হিসাববছরে ৪০ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকার সিগারেট বিক্রি করে। এ সময় তাদের মুনাফা হয় এক হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। ২০২২ সালে বিএটি ৩৬ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার সিগারেট বিক্রি করেছিল। এর বিপরীতে এক হাজার ৭৮৭ কোটি মুনাফা করে কোম্পানিটি। আর ২০২১ সালে ৩৩ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা বিক্রির বিপরীতে এক হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা মুনাফা লাভ করে বিএটি।
যদিও এর তিন বছর বিএটির সিগারেট বিক্রি থেকে আয় ছিল যথাক্রমে ২০১৮ সালে ২৩ হাজার ৩১২ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে ২৬ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ও ২০২০ সালে ২৮ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই তিন বছরে কোম্পানিটির আয় ছিল ৭৮ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। আর ওই তিন বছরে কোম্পানিটির মুনাফা ছিল যথাক্রমে এক হাজার এক কোটি টাকা, ৯২৫ কোটি টাকা ও এক হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ শেষ তিন বছরে বিএটির আয় ও মুনাফায় বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে।
যদিও গত কয়েক বছরে দেশে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে আইন কঠোর করা হয়েছে। আইনে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা কার্যক্রম নিষিদ্ধ, অপ্রাপ্ত বয়স্কদের কাছে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ, সব ধরনের পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহন সম্পূর্ণ ধূমপানমুক্ত, সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কীকরণ বাণী মুদ্রণ এবং তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে যে কোনো উপায়ে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার না করার কথা কথা বলা হয়েছে। এগুলো অমান্য করা হলে অর্থদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় জোরেশোরে ব্যবসা করছে কোম্পানিগুলো। এক জর্দা ব্যবসায়ী দেশের শীর্ষ করদাতা বলে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। আবার ঢাকাসহ সারাদেশের প্রধান শহরগুলোর জনসমাগম স্থলে খুচরা বিক্রয় কেন্দ্র, স্থাপনাসহ ছোট বোর্ডে নানা কৌশলে প্রচারণাও চালাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। এছাড়া নিম্নস্তরের সিগারেটের সুলভ মূল্যও কোম্পানিটির বিক্রি, আয় ও মুনাফা বৃদ্ধির কারণ বলে মনে করছেন তারা। আর সিগারেটে শুল্ক বৃদ্ধি করা হলেও তা বর্তমান মূল্যস্ফীতি বা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সুলভ হওয়াকে এর ব্যবহার না কমার কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
তামাকবিরোধী জোট প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, তামাক পণ্যে যে হারে করারোপ বা কর সংস্কার করার কথা, সে হারে করারোপ করা হয়নি। মানুষের আয় ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দাম বাড়ানো হয়নি। এছাড়া তামাকের যে হারে দাম বাড়ানোর কথা তা করা হয়নি। নিত্যপণ্যের তুলনায় যদি তামাক পণ্যের দাম কম হয়, তাহলে ব্যবহার তো কমবে না, বরং বাড়বে। কারণ তামাক বা সিগারেট নেশাজাতীয় পণ্য।
তিনি বলেন, ‘তামাকের মূল্য বৃদ্ধি আর আইনÑদুটো দুই জিনিস। মূল্য বৃদ্ধি এনবিআর বা অর্থ মন্ত্রণালয় করে। তামাকের কর বাড়াতে আমরা প্রতিবছর বলে আসছি। কিন্তু সে হারে কর বাড়ানো হয়নি। আরেকটি বিষয় হলো বাংলাদেশে টোব্যাকো ট্যাকসেশন নিয়ে কোনো আইন হয়নি। অর্থাৎ তামাক কর নীতিমালা করা হয়নি। এনবিআর আর কোম্পানিগুলো আলোচনা করে মূল্য নির্ধারণ করে। আর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন হলো তামাকের ব্যবহার রোধে করা। সেই আইনও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি।’
প্রসঙ্গত, ২০২০-২১ অর্থবছর নিম্নস্তরের সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক ধার্য করা হয় ৫৭ শতাংশ, যা তার আগের অর্থবছর ছিল ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র দুই শতাংশ বাড়ানো হয় সম্পূরক শুল্ক। আর ২০২১-২২ অর্থবছর উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের দাম যথাক্রমে পাঁচ টাকা এবং সাত টাকা বৃদ্ধি করে ১০২ টাকা এবং ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানো হয় দুই দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর মধ্যম, উচ্চ ও অতি উচ্চস্তরে দাম বাড়ানো হয় যথাক্রমে তিন দশমিক ১৭ শতাংশ, আট দশমিক ৮২ শতাংশ এবং পাঁচ দশমিক ১৮ শতাংশ।
চলতি অর্থবছর বাজেটে মূল্যস্তরভেদে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য এক দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। যদিও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এসব শুল্ক বৃদ্ধি তুলনামূলক অনেক কম। বিশেষজ্ঞরা একে আইওয়াশ বলেও মন্তব্য করেন।
বিএটির তথ্যমতে, কোম্পানিটির বিক্রি হওয়া সিগারেটের ৭৭ শতাংশই নিম্নস্তরের (রয়েল, ডার্বি, হলিউড ও পাইলট)। বাকি মাত্র ২৩ শতাংশ মধ্য ও উচ্চস্তরের সিগারেট। ২০২৩ সালে বেনসন ও গোল্ড লিফ বিক্রি আগের বছর চেয়ে কমেছে যথাক্রমে ৯ শতাংশ এবং ১২ শতাংশ। আর এই সময়ে নিম্নস্তরের সিগারেট বিক্রি বেড়েছে ৯ শতাংশ। এই নিম্নস্তরের উপর ভিত্তি করে মুনাফা বাড়ছে কোম্পানিটির।
উল্লেখ্য, বর্তমানে বাজারে উচ্চস্তরের সিগারেটের তালিকায় থাকা বেনসন প্রতি শলাকা ১৮ টাকা এবং গোল্ড লিফ প্রতি শলাকা ১৩ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর মধ্যম স্তরের মধ্যে লাকি স্টাইক প্রতি শলাকা ১০ টাকা, স্টার ৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে নিম্নস্তরের মধ্যে ডার্বি ৫ টাকা, হলিউড ৫ টাকা এবং পাইলট ৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ ২০২০ সালে ছিল বেনসন ছিল ১৩ টাকা। ওই সময় ডার্বি-হলিউড ও পাইলট ৪ টাকা দরে বিক্রি হতো। অর্থাৎ গত কয়েক বছরে উচ্চস্তরের সিগারেটের দাম অধিক হারে বাড়লেও নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম তেমন বাড়েনি। বহুস্তর শুল্ক কাঠামো থাকায় নিম্নস্তরের সিগারেট সস্তা ও সহজলভ্য রয়ে গেছে।
অন্যদিকে অভিজাত সিগারেট কোম্পানিগুলোর ব্যবসা অধিক হারে সম্প্রসারণে দেশীয় বিড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়েছে। ওই জায়গা ঢাকাসহ সারাদেশে দখল করেছে সহজলভ্য ও নিম্নস্তরের সিগারেট।