ইসমাইল আলী: প্রতি বছর বাড়ছে সরকারের বাজেটের আকার। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাজেট ঘাটতি। সে ঘাটতি মেটাতে দেশীয় উৎস তথা ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে নিয়মিত ঋণ নিচ্ছে সরকার। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণ নেয়ার পরিমাণও বাড়ছে। তবে ঋণের পরিমাণ দ্রুত বাড়তে থাকায় এর সুদ পরিশোধ এখন সরকারের জন্য বোঝা হয়ে উঠেছে।
চলতি অর্থবছর বাজেটের ১২ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থ যাচ্ছে সুদ পরিশোধে। তবে তিন বছর পর ২০২৬-২৭ অর্থবছর এ খরচ অনেকটা বেড়ে যাবে। ওই অর্থবছর সুদ পরিশোধে বাজেটের ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যয় করতে হবে। অর্থ বিভাগের প্রকাশিত ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি: ২০২৪-২৫ হতে ২০২৬-২৭’ শীর্ষক প্রকাশনায় এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সহায়ক প্রকাশনা হিসেবে এটি গত ৬ জুন প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে দেখা যায়, ২০২৬-২৭ অর্থবছর সরকারের সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে যাবে এক লাখ ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ২৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছর সুদ পরিশোধে মোট ব্যয় এক লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দাঁড়াবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। যদিও সরকার ঋণ গ্রহণে সংযত না হলে ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আরও বেড়ে গেলে সুদ পরিশোধের পরিমাণ এর চেয়ে বেশি হবে বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে সুদ পরিশোধ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘মধ্যমেয়াদে সরকারের প্রাক্কলিত সুদ ব্যয় এ খাতে সরকারের ক্রমবর্ধমান ব্যয় প্রবণতা নির্দেশ করে। সুদ পরিশোধের প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের সুদ ব্যয় ৭৭৭.৭ বিলিয়ন টাকা হতে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ১,৫৪৫ বিলিয়ন টাকা হতে পারে।’ অর্থাৎ ছয় বছরে সুদ পরিশোধ ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘মোট সুদ ব্যয়ের বেশিরভাগ ব্যয় হয় অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের ৭৩২.১৮ বিলিয়ন টাকা হতে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে ১,২৮৫ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধের অংশ ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটের ১৪.১ শতাংশ হতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১১.৭ শতাংশে হ্রাস পাবে। তবে তা ২০২৬-২৭ অর্থবছরে পুনরায় ১২.৭ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।’
বিদেশি ঋণের সুদ প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগ বলছে, ‘যদিও মোট সুদ ব্যয়ে বৈদেশিক সুদের অংশ খুবই কম তথাপি বৈদেশিক সুদের পরিমাণ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৫.৬ বিলিয়ন টাকা হতে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ২৬০ বিলিয়ন টাকা হতে পারে। মোট বাজেটে বৈদেশিক সুদের অনুপাতও ২০২১-২২ অর্থবছরের ০.৯ শতাংশ হতে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ২.৬ শতাংশ হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। বাজেটে বৈদেশিক ঋণের সুদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব লক্ষণীয়।’
গত কয়েক বছরের বাজেটের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছর সরকারের সুদ পরিশোধ ব্যয় ছিল ৩৫ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ করা হয় ৩৩ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা আর বৈদেশিক ঋণের সুদ ছিল এক হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪১ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় দাঁড়ায় ৩৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা ও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় ছিল তিন হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
২০১৮-১৯ অর্থবছর সুদ পরিশোধ ব্যয় আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ছিল ৪৬ হাজার ১৫ কোটি টাকা ও বৈদেশিক ঋণের সুদ তিন হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ আগের অর্থবছরের চেয়ে কিছুটা হ্রাস পায়। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরও বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় সামান্য হ্রাস পেয়েছিল।
২০১৯-২০ অর্থবছর সুদ পরিশোধ ব্যয় আরেক দফা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫৮ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ছিল ৫৩ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা ও বৈদেশিক ঋণের সুদ চার হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। যদিও পরের অর্থবছর সুদ পরিশোধ অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। ওই অর্থবছর সুদ পরিশোধ করা হয় ৭০ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ছিল ৬৬ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা ও বৈদেশিক ঋণের সুদ চার হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছর সুদ পরিশোধ রেকর্ড ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
যদিও ২০২১-২২ অর্থবছর এ খাতে ব্যয় তুলনামূলক কম বাড়ে। ওই অর্থবছর সুদ পরিশোধ করা হয় ৭৭ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ছিল ৭৩ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ও বৈদেশিক ঋণের সুদ চার হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছর সুদ পরিশোধ ব্যয় আবারও এক লাফে প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
ওই অর্থবছর সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৯২ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ছিল ৮২ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা ও বৈদেশিক ঋণের সুদ ৯ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছর বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ ১০৭ শতাংশের বেশি বাড়ে, যা মোট সুদ পরিশোধে চাপ সৃষ্টি করে। যদিও অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধ ব্যয়ের ধারা কয়েক বছর ধরেই একই হারে বাড়ছে।
এদিকে চলতি অর্থবছর সুদ পরিশোধ ব্যয়ও লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে সুদ পরিশোধের পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে যাবে ৮৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ও বৈদেশিক ঋণের সুদ দিতে হবে ১৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এ হিসাবে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত ৮ বছরে সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে তিনগুণ হয়েছে।
অন্যদিকে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে সুদ পরিশোধের পরিমাণ ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯৩ হাজার কোটি টাকা ও বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ করতে যাবে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ এক বছরে বাড়ছে প্রায় চার হাজার ৭০০ কোটি টাকা বা প্রায় ৩০ শতাংশ।
বাজেট বক্তব্যে বিদেশি ঋণের সুদ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর) বিশ্বে সুদের হারের অন্যতম রেফারেন্স রেট হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। ২০২২ সালে জানুয়ারিতে এ হার ছিল শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুদের হার বৃদ্ধির কারণে সোফরও বাড়তে থাকে। গত মাসে তা সাড়ে পাঁচ শতাংশে পৌঁছেছে। ইউরোপসহ অন্যান্য উন্নত দেশেও একই কারণে সুদের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউরিবর, টোনার মতো রেফারেন্স রেটও বাড়ছে এজন্য।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বে সুদের হার বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশকে দুই ধরনের চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে সুদের হার বৃদ্ধির কারণে মূলধনের বহিঃপ্রবাহের (বিনিয়োগ চলে যাওয়া) গতি বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তঃপ্রবাহ (বিদেশি বিনিয়োগ আসা) কমার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে একদিকে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বাড়ছে, অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছর বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ এক বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোয় আগামীতে সুদের হার কমার পূর্বাভাস রয়েছে। এটি সঠিক না হলে আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
আগামীতে সুদ পরিশোধ ব্যয় কেমন হবে তার প্রক্ষেপণও করেছে অর্থ বিভাগ মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে। এতে দেখা যায়, ২০২৫-২৬ অর্থবছর সুদ পরিশোধে ব্যয় হতে পারে এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে যাবে এক লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ও বিদেশি ঋণের সুদ দিতে হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছর বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাড়বে প্রায় ১১ শতাংশ। তবে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় বাড়বে প্রায় সাড়ে ২২ শতাংশ।
আর ২০২৬-২৭ অর্থবছর সুদ পরিশোধে ব্যয় হতে পারে এক লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছর সুদ পরিশোধ ব্যয় বাড়বে প্রায় ১৩ শতাংশ। ২০২৬-২৭ অর্থবছর অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ও বিদেশি ঋণের সুদ দিতে হবে ২৬ হাজার কোটি টাকা।
সুদ ব্যয় বৃদ্ধি বাজেটের ওপর কী ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য শেয়ার বিজকে বলেন, সুদ পরিশোধ এখন পরিচালন বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ অর্থ নিয়ে নিচ্ছে। এছাড়া ভর্তুকিতেও বড় অর্থ ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু ভর্তুকি ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। সুদ ও ভর্তুকিতেই যদি বাজেটের বড় অংশ চলে যায়, তাহলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের মতো খাতে অর্থের জোগান বাড়ানো কঠিন হবে। এমন পরিস্থিতিতে সুদ ব্যবস্থাপনায় নজর দেয়া আবশ্যক।