ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় গত কয়েক বছর ধরে বাড়ছে। তবে গত অর্থবছর তা রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। এতে প্রথমবারের মতো গড় উৎপাদন ব্যয় দুই অঙ্ক (ডাবল ডিজিট) ছাড়িয়েছে। এতে তিন বছরে গড় উৎপাদন ব্যয় দ্বিগুণ হয়েছে। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে নামমাত্র প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এতে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার (ভোগ) কিছুটা কমেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, জ্বালানি ঘাটতিতে বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় অংশই বসে ছিল গত অর্থবছর। এতে মোট উৎপাদনে মাত্র সোয়া তিন শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা করোনার পর সর্বনিম্ন। তবে স্থায়ী ব্যয় তথা ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই বহন করতে হয়েছে। এছাড়া উচ্চ জ্বালানি ব্যয়ের কারণেও গড় ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৯১১ মেগাওয়াট। ওই সময় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল (আমদানিসহ) আট হাজার ৮৪৫ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবির মোট ব্যয় হয় এক লাখ চার হাজার ৯০১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়েছে ১১ টাকা ৮৬ পয়সা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন।
এর আগের (২০২১-২২ অর্থবছর) দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২২ হাজার ২২৯ মেগাওয়াট। ওই অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল (আমদানিসহ) আট হাজার ৫৬০ কোটি ৭০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবির মোট ব্যয় হয়েছিল ৭৫ হাজার ৬৭৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। সে বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়েছিল আট টাকা ৮৪ পয়সা। এ হিসাবে গত অর্থবছর গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৩৪ দশমিক ১৬ শতাংশ।
এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২২ হাজার ৩১ মেগাওয়াট। ওই অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল (আমদানিসহ) আট হাজার ৪২ কোটি ৩০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। তা উৎপাদনে পিডিবির মোট ব্যয় পড়ে ৫৩ হাজার ১৫৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়ে ছয় টাকা ৬১ পয়সা। অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বাড়ে ৩৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
এর আগের অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১৮ হাজার ৯৬৬ মেগাওয়াট। তবে করোনা সংক্রমণের কারণে ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি থাকায় ওই অর্থবছর বিদ্যুতের চাহিদা ছিল অনেক কম। ওই অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল সাত হাজার ১৪১ কোটি ৮০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। সে অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবির মোট ব্যয় হয় ৪২ হাজার ২০৮ কোটি চার লাখ টাকা। অর্থাৎ গড় ব্যয় পড়ে পাঁচ টাকা ৯১ পয়সা। এ হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ে ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
চার অর্থবছরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তিন বছরের ব্যবধানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণের চেয়েও কিছুটা বেশি। তবে এ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ২৪ শতাংশেরও কম। এর মধ্যে গত অর্থবছর প্রবৃদ্ধি ছিল সবচেয়ে কম।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, গত অর্থবছর হঠাৎ করে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। এছাড়া গত বছর জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কয়লা ও জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এক সময় তা রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। তবে জানুয়ারি থেকে দাম কমতে শুরু করে। মূলত উচ্চ জ্বালানি ব্যয়ের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। তার ওপর চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন বেড়েছে খুবই কম। তবে স্থায়ী ব্যয় (ক্যাপাসিটি চার্জ) ঠিকই বহন করতে হয়েছে। এ কারণেও গড় ব্যয় বেড়ে গেছে।
পিডিবির তথ্য বলছে, গত অর্থবছর দেশে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ৪৬৪ দশমিক ১৩ ইউনিট। ২০২২-২৩ অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ৪৬৪ দশমিক ২০ ইউনিট, ২০২১-২২ অর্থবছর ৪২২ দশমিক ২০ ইউনিট ও ২০১৯-২০ অর্থবছর ৩৭৮ দশমিক ১৬ ইউনিট। আর ২০২০-২১ অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হয় ১২ দশমিক ৬১ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছর ছয় দশমিক ৪৫ শতাংশ ও ২০২২-২৩ অর্থবছর তিন দশমিক ৩২ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, বর্তমান সরকার ক্ষমতার গ্রহণের সময় ২০০৮-০৯ অর্থবছর দেশে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল দুই টাকা ৫৩ পয়সা। পরের অর্থবছর তা সামান্য বেড়ে হয় দুই টাকা ৫৮ পয়সা। ২০১০-১১ অর্থবছর উৎপাদন সক্ষমতা অনেকটাই বাড়ে। ওই বছর বেশ কয়েকটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করে। এর প্রভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন গড় ব্যয় বেড়ে হয় তিন টাকা ৯৫ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছর তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৩৬ পয়সা ও ২০১২-১৩ অর্থবছর পাঁচ টাকা ৭৭ পয়সা।
২০১৩-১৪ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়ে। ওই অর্থবছর গড় ব্যয় দাঁড়ায় ছয় টাকা ২৮ পয়সা। পরের অর্থবছর তা এক পয়সা কমে দাঁড়ায় ছয় টাকা ২৭ পয়সা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী হওয়ার প্রভাব পড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ে। ওই অর্থবছর গড় ব্যয় কমে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৫৫ পয়সা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর তা সামান্য বেড়ে হয় পাঁচ টাকা ৬৯ পয়সা। ২০১৭-১৮ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন গড় ব্যয় আবারও ছয় টাকা ছাড়ায়। ওই অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ছয় টাকা ৩৩ পয়সা।
পরের দুই বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় ব্যয় হ্রাস পায়। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ছয় টাকা এক পয়সা ও ২০১৯-২০ অর্থবছর পাঁচ টাকা ৯১ পয়সা। এরপর থেকে গড় ব্যয় দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে।