নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় দোকান মালিক ও কর্মীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষের ঘটনায় শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীসহ প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষকে আসামি করে তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে একটি মামলা করেছেন নিউমার্কেট থানার এসআই মেহেদী হাসান। একই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়ামিন কবির দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জ্বালাও-পোড়াও, পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে আরেকটি মামলা করেছেন। আর সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে নিহত ডেলিভারিম্যান নাহিদ মিয়ার চাচা মো. সাঈদ দায়ের করেছেন একটি হত্যা মামলা।
নিউমার্কেট থানার ওসি শ ম কাইয়ুম বলেন, বুধবার রাতেই মামলা তিনটি রেকর্ড করা হয়। মেহেদী হাসানের মামলায় আসামি ১৫০ থেকে ২০০, সাঈদের মামলায় ১০০ থেকে ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আর ইয়ামিন কবিরের করা মামলায় ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে নিউমার্কেটের অজ্ঞাতপরিচয় ২০০ থেকে ৩০০ ব্যবসায়ী ও কর্মী এবং ৬০০ থেকে ৭০০ কলেজ শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়েছে।
এজাহারে কাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছেÑজানতে হাইলে ওসি বলেন, তাদের নাম এসেছে উসকানিদাতা হিসেবে। বিস্তারিত এখন বলা যাচ্ছে না।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দোকানকর্মীদের রক্তক্ষয়ী ওই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছিল গত সোমবার রাতে নিউমার্কেটের একটি খাবারের দোকানে ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র মারধরের শিকার হওয়ার পর। দোকান মালিকরা জানান, দুই দোকানের কর্মীদের বচসা থেকে এক পক্ষ ঢাকা কলেজ ছাত্রাবাস থেকে ছাত্রলীগের কয়েক কর্মীকে ডেকে আনে। তারা গিয়ে মারধরের শিকার হওয়ার পর ছাত্রাবাসে ফিরে আরও শিক্ষার্থীদের নিয়ে মধ্যরাতে নিউমার্কেটে হামলা চালাতে গেলে বাধে সংঘর্ষ।
মঙ্গলবার দিনভর চলা এই সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন। তাদের মধ্যে নাহিদ মিয়া নামের ১৮ বছর বয়সী এক তরুণকে রাস্তার ওপর কোপানো হয়। এলিফ্যান্ট রোডের ডেটা টেক কম্পিউটার নামের একটি দোকানের ডেলিভারি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করতেন নাহিদ। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার রাতে তার মৃত্যু হয়।
পুলিশের করা সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাহিদের মাথার বাম পাশে পাশাপাশি চারটি কাটা জখম ছিল, জখমগুলো দুই থেকে সাড়ে তিন ইঞ্চি লম্বা। চারটি জখমে ২৩টি সেলাই দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। পিঠের বাম পাশে পাশাপাশি তিনটি কাটা জখম, যার প্রত্যেকটি পাঁচ ইঞ্চি করে লম্বা। বাঁপায়ের গোড়ালির নিচে কাটা জখমেও পাঁচটি সেলাই লেগেছিল; এছাড়া উভয় পায়ের বিভিন্ন জায়গায় নীল-ফোলা কালা জখম ছিল। নাক-মুখের ছোলা জখম ছিল।
মঙ্গলবার সংঘর্ষের মধ্যে ইটের আঘাতে আহত মোরসালিন নামের এক দোকান কর্মচারীও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন গতকাল ভোরে। এ বিষয়ে এখনও কোনো মামলা হয়নি থানায়।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে দুদিন বন্ধ থাকার পর খুলতে শুরু করেছে রাজধানীর নিউমার্কেট ও আশপাশের বিপণিবিতানগুলো। বুধবার মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত দীর্ঘ বৈঠকে শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা সমঝোতায় পৌঁছালে গতকাল নিউমার্কেট খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর সকাল ১০টায় নিউমার্কেটের চারটি ফটকের মধ্যে তিনটি খুলে দেয়া হয়।
মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী নান্নু খান জানান, এক, দুই ও তিন নম্বর ফটক খুলে দেয়া হয়েছে। চার নম্বর ফটক ভাঙা থাকায় সেটি মেরামতের পর খোলা হবে। সোমবার রাতে ওই ৪ নম্বর ফটক দিয়েই সংঘর্ষের সূচনা হয়।
‘ক্যাপিটাল হোস্টেল’ ও ‘ওয়েলকাম’ নামে দুই খাবারের দোকানের কর্মচারীদের ঝামেলায় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কিছু কর্মী জড়িয়ে গেলে বিষয়টি বিরাট আকার ধারণ করেছিল সেই রাতে। মঙ্গলবার দিনভর ওই এলাকায় সংঘর্ষ চলে, তাতে আহত হয় অর্ধশতাধিক, পরে তাদের দুজনের মৃত্যু হয়।
গতকাল সকালে নিউমার্কেটের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল হোস্টেল ছাড়া বাকি দোকানগুলো খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
নিউমার্কেট ছাড়াও পাশের চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট ও অন্য বিপণিবিতানগুলোও খুলতে শুরু করেছে। দোকানিরা ঝাড়ামোছা করে পণ্য গুছিয়ে বসছেন ক্রেতার অপেক্ষায়।
সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত এলাকায় কয়েক ডজন মার্কেটে ১০ হাজারের মতো দোকান রয়েছে। মহামারির ধাক্কা সামলে এবারের ঈদে ভালো বেচাকেনার আশায় ছিলেন ব্যবসায়ীরা; তার মধ্যেই এ সংঘর্ষ অনেককে ক্ষতিতে ফেলেছে। সোমবার মধ্যরাতে সংঘর্ষ শুরুর পর এ এলাকার সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়। মঙ্গলবার সারাদিন সংঘর্ষের মধ্যে কোনো কোনো দোকানে হামলাও হয়।
পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে বুধবার বিকালে সংবাদ সম্মেলন করে দোকান খোলার ঘোষণা দেন মালিক সমিতির নেতারা। গাউছিয়া, বলাকা ভবন, চাঁদনী চকের কিছু দোকান খুলতেও শুরু করে। কিন্তু বিকালে ঢাকা কলেজের ফটকের সামনে কয়েকটি হাতবোমা ফাটার পর সেই চেষ্টা বন্ধ হয়ে যায়।
গভীর রাতে চার ঘণ্টার বৈঠক শেষে সমঝোতা হওয়ার কথা জানান ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের মহাপরিচালক নেহাল আহমেদ। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বৃহস্পতিবার থেকে নিউমার্কেটসহ ওই এলাকার সব বিপণি কেন্দ্রগুলো খুলবে। আর ছুটির মধ্যে ছাত্রদের হলে থাকার বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে। বৈঠকের পর আর কোনো বিভেদ থাকবে না বলে আশা করছি।